|
ভারত-ইসরায়েলের বিনিয়োগ চুক্তি: আঞ্চলিক করিডর পরিকল্পনার নতুন ইঙ্গিত?
নতুন সময় ডেস্ক
|
![]() ভারত-ইসরায়েলের বিনিয়োগ চুক্তি: আঞ্চলিক করিডর পরিকল্পনার নতুন ইঙ্গিত? ফিলিস্তিনের গাজায় চলছে ইসরায়েলের বর্বরোচিত গণহত্যা। গাজা সিটিতে চলছে ক্রমাগত হামলা। অধিবাসীদের দ্রুত শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে ইসরায়েল, এ অবস্থায় দেশটির কট্টর-ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচের ভারত সফরে। দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সফররত ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী স্মৎরিচ ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বৈঠক করে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি সই করেন। চুক্তিটি করা হয়েছে বিনিয়োগকারীদের জন্য নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা প্রদান, বাণিজ্য ও পারস্পরিক বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে। এতে বিনিয়োগের অধিগ্রহণ থেকে সুরক্ষা, পুঁজির নির্বিঘ্ন স্থানান্তর এবং ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ স্মোটরিচ লিখেছেন, ‘এই চুক্তি আমাদের যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ।’ এই যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর ছাড়িয়ে আরো বড় ইঙ্গিত হলো, ২০২৩ সালে ঘোষিত মার্কিন সমর্থিত ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি) প্রকল্পকে নিঃশব্দে এগিয়ে নেওয়া। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন সমুদ্রপথ, রেল, জ্বালানি ও ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলে ভারতকে উপসাগর ও ইসরায়েলের মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। যদিও শুরুতে প্রকল্পটি অনেক আশাব্যঞ্জক ছিল, তবে পরে গাজা যুদ্ধের কারণে এটি স্থবির হয়ে যায়। বর্তমানে ইসরায়েল ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ৮০০ মিলিয়ন ডলার এবং বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগে শক্তিশালী সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি অবকাঠামো, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও ডিজিটাল সংযোগে সহযোগিতার মাধ্যমে এই চুক্তি ভবিষ্যতে আঞ্চলিক সংযোগের জন্য আরো বড় কাঠামো গড়ে তোলার ভিত্তি তৈরি করতে পারে। ভারত ও ইসরায়েল ইতিমধ্যেই কৌশলগত অংশীদার। তাদের সম্পর্ক প্রতিরক্ষা, কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে বিস্তৃত। তবে ইসরায়েলের জন্য এই চুক্তিটি হয়েছে এক সংবেদনশীল সময়ে। গাজা যুদ্ধের জেরে কিছু বড় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ইতিমধ্যেই পিছু হটেছে। গত ২৯ জুলাই ইউরোপীয় কমিশন ইসরায়েলের ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯৫ বিলিয়ন ইউরোর প্রধান গবেষণা ও উদ্ভাবন কর্মসূচি ‘হরাইজন ইউরোপ’-এ অংশগ্রহণ আংশিকভাবে স্থগিত করার প্রস্তাব দিয়েছে। এর ফলে ইসরায়েলি স্টার্টআপগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ড্রোন ও সাইবার নিরাপত্তার মতো উদ্ভাবনী প্রযুক্তির জন্য অনুদানের প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। এদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নরওয়ের সার্বভৌম সম্পদ তহবিলও ইসরায়েলি কম্পানিতে তার বিনিয়োগ আরো কমিয়েছে। যা গত জুনে তাদের ইসরায়েলি তালিকাভুক্ত ৬১টি কম্পানিতে বিনিয়োগ থাকলেও, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮টি কম্পানিতে। নরওয়ের অর্থমন্ত্রী জেন্স স্টোলটেনবার্গ সতর্ক করেছে, ‘আরো অনেক কম্পানিকে বাদ দেওয়া হতে পারে।’ এই প্রেক্ষাপটে ভারতের বিনিয়োগ সুরক্ষার আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার দিচ্ছে। ভারতের এই পদক্ষেপ তার আঞ্চলিক সংযোগ বাড়ানোর বৃহত্তর লক্ষ্যকেও প্রতিফলিত করছে। ‘আইএমইসি’-এর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এমনটি ঘটল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অংশ নিয়েছে। এই করিডরের কাঠামোতে এমন একটি অবকাঠামো নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা ভারত থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। উপসাগরের বন্দরগুলো সৌদি আরব, জর্দান ও ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে রেলপথে সংযুক্ত হবে এবং সেখান থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপের বন্দরগুলোতে পৌঁছাবে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘আইএমইসি’কে বলা হচ্ছে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ। মৌলিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের কয়েক সপ্তাহ পর ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা হয় ইসরায়েলে এবং পরবর্তী গাজা যুদ্ধ কার্যত সৌদি-ইসরায়েলের সম্পর্কের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়। আরব-ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে ‘আইএমইসি’ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রকল্পটির কেন্দ্রীয় অংশ হলো সৌদি-জর্দান-ইসরায়েল রেলপথ সংযোগ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিকে ‘ইতিহাসের অন্যতম সেরা বাণিজ্যপথ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু গাজা যুদ্ধ আঞ্চলিক একীকরণকে বিশেষ করে আরব সরকারগুলোর কাছে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ও অজনপ্রিয় করে তুলেছে, কারণ তাদের জনগণ এই সংঘাত নিয়ে ক্ষুব্ধ। ফলে উদ্যোগটির অগ্রযাত্রা থমকে গেছে। এই জটিলতা সত্ত্বেও ভারত কৌশলগতভাবে করিডরের মূল দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গভীর করে চলেছে। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইসরায়েল। এই সপ্তাহের ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের চুক্তিটি ২০২৪ সালে ভারতের সঙ্গে আমিরাতের স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির প্রতিচ্ছবি। ২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরব সফর করেন। সেখানে তিনি ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ভারত-সৌদি কৌশলগত অংশীদার পরিষদ সম্প্রসারণ করেন এবং নতুন জ্বালানি ও বিনিয়োগ প্রকল্পে সম্মত হন। দুই নেতা মহাকাশ, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও ডাক বিভাগে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পরিচালনার জন্য মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল-ভারত চুক্তিটি দ্বিপাক্ষিক হলেও এটিকে ‘আইএমইসি’-এর ধারণাকে জীবিত রাখার একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যদিও এর রাজনৈতিক ভিত্তি অনিশ্চিত রয়ে গেছে। আইএমইসি তার মূল রূপে পুনর্জীবিত হবে কি না, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে ভারত-ইসরায়েলের এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ইঙ্গিত দিচ্ছে, আঞ্চলিক একীভূত হওয়ার অর্থনৈতিক যুক্তি নীরবে অগ্রসর হচ্ছে, যদিও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তার পেছনে পড়ে আছে। তবে এই সফরের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরো গভীর করল। |
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
