|
অদম্য পরিশ্রমী সফল একজন আদিবাসী নারী উদ্যোক্তা চিত্রা নকরেক
জহিরুল ইসলাম মিলন, টাঙ্গাইল
|
![]() অদম্য পরিশ্রমী সফল একজন আদিবাসী নারী উদ্যোক্তা চিত্রা নকরেক আজকের “নকরেক ক্রাফট” তাঁর নিজ হাতে গড়া বাঁশের তৈজসপত্রের এমনি একটি অন্যন্য সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালার বাহারি রঙ ও ডিজাইনের বাঁশের তৈজসপত্র এলকার গণ্ডি পেরিয়ে দেশে-বিদেশে বিক্রি হচ্ছে এবং সংগ্রহের ঝুলিতে জমা হচ্ছে বৈদেশিক মূদ্রা। এ উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছানোর জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম, অসীম মনোবল ও অধ্যাবসায়কে পুঁজি করেছেন। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার পীরগাছা গ্রামের গারো পরিবারের মৃত গুণেন্দ্র স্কু ও মাতা বিনিতা নকরেক দম্পতির মেয়ে চিত্রা নকরেক। তাঁর স্বামী অসীম মৃ একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। দুই সন্তানের জননী চিত্রা নকরেকের বয়স ৩৮ বছর। তিনি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পীরগাছা সেন্ট পৌলস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হোন মধুপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সুনামের সাথে এসএসসি ও জামালপুর জাহেদা শফির গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ডিগ্রি পাশ করেন। এখানেই শিক্ষা জীবন শেষ করে বেছেনেন শিক্ষকতা পেশা এবং নিজেকে যুক্ত করেন স্থানীয় সেন্ট পৌলস উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে । শিক্ষকতা ছেড়ে নকরেক ক্রাফটের যাত্রা যেভাবে - শিক্ষকতার পাশাপাশি চিত্রা নকরেক তাঁর এলাকায় পরিচালিত এক বাঁশের তৈরি তৈজসপত্র কারখানার প্রতি আকৃষ্ট হোন। সেই থেকে নিয়মিত যাতায়াত করতেন তিনি। বাহারি কাজ দেখে ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। হঠাৎ একদিন কারখানার মালিক ব্যবসা গুটিয়ে চট্টগ্রাম চলে যান। এঘটনায় কারখানার নিরীহ শ্রমিকগুলো মহাবিপদে পড়ে যান। তখন তাঁরা নিরুপায় হয়ে চিত্রা নকরেককে কারখানা পরিচালনা করার জন্য অনুরোধ জানান। তখন তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে শলাপরামর্শ শেষে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন। গত ২০২০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি 'নকরেক ক্রাফট' নামে এ ব্যবসা শুরু করেন। যে ধরণের তৈজসপত্র পাওয়া যায় এখানে - চিত্রা নকরেক জানান, তাঁর নকরেক ক্রাফট প্রতিষ্ঠানে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত ব্যবহৃত তৈজসপত্র তৈরি হয়। এর মধ্যে পূজা পার্বণে ববহৃত গাছেক বা মদ রখার থোড়া। কত্থক যা জুম চাষের বীজ বোনার কাজে লাগে ও পানির বোতল রাখা এবং ফুলদানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া বুরাং বা টংঘর, বাজারের ব্যাগ, ভারী লাগেজ। সৌখিন মানুষের ব্যবহারের জন্য বাঁশের ল্যাম্প, বাজারের ব্যাগ, হ্যান্ডেল ব্যাগ, ফাইল বক্স, ডাস্টবিন সোপিস, বাঁশ ও কাঠের ফুল, ট্রে, হাতপাখা ফুলঝুরি, গারোদের আদি ঐতিহ্যের টং ঘর প্রভৃতি। মেয়েদের ব্যবহারের জন্য কাঠ ও বাঁশের তৈরি চুলের ক্লিপ, খোপা, জুয়েলারি বক্স। গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের জন্য কুলা, চালুন, চামচ, খুন্তি ইত্যাদি। তাঁর প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে দামি ফার্নিচার হচ্ছে রাজা বাঁশের তৈরি টি-টেবিল ও সোফাসেট। এই সৌখিন পন্য ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয় বলে চিত্রা নকরেক জানান। উপকরণ এসব তৈজসপত্র তৈরির কাজে টলা বাঁশ, সুন্দরী বাঁশ, তারাই বাঁশ ও বেতের প্রয়োজন হয়। এসব তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। বাঁশ-বেত সংগ্রহ ও কাটাকাটির কঠিন কাজ তিনি পুরুষ শ্রমিক দিয়ে করিয়ে থাকেন। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা মোট ২০ জন। তার মধ্যে ১৫ জনই নারী ও বাকি ৫ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির হতদরিদ্র মানুষ। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসে কাজের বেশি চাহিদা থাকে। এসময় শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ জনে। শ্রমিকদের মাসিক গড় বেতন ১২ হাজার টাকা। কেউ কেউ প্রোডাকশনে কাজ করে মাসে গড়ে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান। নারী শ্রমিকরা নিজ বাড়িতে বসে কাজ করে থাকেন। কাজ শেষে পীরগাছা বাজারের ’নকরেক ক্রাফট’ শোরুমে পৌঁছে দেন তারা। চিত্রা নকরেক জানান, আমার ‘নকরেক ক্রাফট’ এর তৈজসপত্র পাহাড়ি মানুষগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করে। তাছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, শ্রীমঙ্গল ও ঘাটাইল সালাহউদ্দিন সেনাবাহিনীবাসে নিয়মিত বিক্রি হয়। তাছাড়া বছরে দু'বার কেয়া কসমেটিকস-এর সৌজন্যে ’হিজল তমাল’ রেস্টুরেন্টে মেলার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে সৌখিন মানুষগুলো আমাদের পন্যগুলো কিনে নেন। তাছাড়া দেশের সুনামধন্য সুপারশপের মালিকগণ তাদের পণ্য নিয়মিত কিনে নেন ও অর্ডার দিয়ে থাকেন। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী এসব পন্য সুনামের সাথে আমরা সরবরাহ করে আসছি। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা ও দামও ভালো। ভালো দাম পেয়ে আমরা অনেক খুশি। এ শিল্পের প্রধান ও জাতীয় সমস্যা হলো প্লাস্টিক ও পলিথিনের তৈরি পণ্যসামগ্রী। এসব পণ্যের কারণে ব্যাপকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং দেশীয় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উপর প্রভাব বিস্তার করছে।
|
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
