|
সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মায়ের পোস্টপার্টাম সাইকোসিস কেন হয়, সমাধান কী
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মায়ের পোস্টপার্টাম সাইকোসিস কেন হয়, সমাধান কী মায়ের মনের এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘পোস্টপার্টাম ব্লু’ বা ‘বেবি ব্লু’। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। গত ১৯ মের ঘটনা। তিন মাস বয়সী এক শিশুকে পানিতে ফেলে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এক মা। ঘটনাটি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার। ঘটনার আগের রাত থেকেই নিজের একমাত্র নবজাতক সন্তানকে নিয়ে গায়েব ছিলেন তিনি। পুলিশের ধারণা, এই নারী মানসিকভাবে অসুস্থ। এ ঘটনার ঠিক ১ মাস আগে, এপ্রিলের ১৯ তারিখে একই ধরনের আরও একটি ঘটনা ঘটে গাজীপুরের টঙ্গিতে। নিজের ছয় ও চার বছর বয়সী দুই সন্তানকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন মা আলেয়া বেগম। মৃত শিশুদের বাবার দাবি, তাঁর স্ত্রী মানসিকভাবে অসুস্থ। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আলেয়া বেগম জানান, হঠাৎই তাঁর মাথায় কী যেন একটা হয়েছে! তখন মনে হয়েছে, সন্তানদের কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে। পরে তিনি বঁটি দিয়ে সন্তানদের কোপ দেন। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরলে দেখেন, তিনি দুই সন্তানকে মেরে ফেলেছেন। এমন ঘটনার নজির শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের নানা দেশেই আছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো শহরের এক নারী তাঁর ১৬ মাস বয়সী মেয়েকে বাড়িতে একা ফেলে রেখে বেড়াতে চলে গিয়েছিলেন ১০ দিনের জন্য। বাড়িতে সম্পূর্ণ একা শিশুটি খাবার আর পানির অভাবে ধুকে ধুকে মারা যায়। এতে ওই নারীর শাস্তি হলেও সেখানকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, আদালতে শিশুটির মায়ের মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করা হয়। এসব ঘটনা স্পষ্টতই মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শিশুর পরম আশ্রয় মা কীভাবে এমনটা করতে পারেন? এ কেমন মানসিক রোগ? বারবার আলোচনায় আসে পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের ব্যাপারটি। রোগটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিলেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম। পোস্টপার্টাম সাইকোসিস কী পোস্টপার্টাম বা প্রসবোত্তর সাইকোসিস হলো একধরনের তীব্র মানসিক ব্যাধি। পাবমেড সেন্ট্রালের জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি এক হাজার নতুন মায়ের মধ্যে সাধারণত এক বা দুইজনের এ সমস্যা দেখা দেয়। এ রোগে সন্তান হওয়ার পর মায়ের যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তা গুরুতর। এতে মা নানান অস্বাভাবিক আচরণ করেন। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। সন্তান প্রতিপালনেও ব্যর্থ হন। রোগী নিজেকে, নিজের সন্তানকে বা পরিবারের অন্য সদস্যদের আঘাত করার চেষ্টা করতে পারেন। লক্ষণ কী কী বেবি ব্লু ও পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে পোস্টপার্টাম সাইকোসিসকে আলাদা করে চিনতে হলে রোগটির লক্ষণগুলো জানা প্রয়োজন। পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের লক্ষণগুলো হলো: হ্যালুসিনেশন বা ভ্রম: এ ধরনের রোগীরা অনেকেই দাবি করেন যে তাঁদের কানে কানে কে যেন কথা বলে। নিজের ও সন্তানের ক্ষতি করতে বলে গায়েবি কেউ। শোনার পাশাপাশি অনেকেই এমন কিছু দেখেন, গন্ধ পান বা অনুভব করেন, যা আদতে সেখানে নেই বা সত্যি নয়। বিভ্রান্তি: বাস্তব জগতের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক না থাকা। মনগড়া চিন্তা করা ও কথা বলা। যেমন মায়ের মনে হতে পারে যে তাঁর সন্তানকে বা তাঁকে কেউ মেরে ফেলতে চাইছে। এসব ভেবে অতিরিক্ত ভয় পান তাঁরা। চিন্তাভাবনার অসঙ্গতি: রোগী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কাজের সঙ্গে কথার মিল থাকে না। বিষণ্নতা: সব সময় মন খারাপ থাকে, কথা বলেন না, কান্নাকাটি করেন এবং পছন্দের বিষয়গুলো থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। উন্মাদনা বা অস্তিরতা: রোগী আত্মহননের চিন্তা, অতিরিক্ত সক্রিয়তা বা আবেগপ্রবণ আচরণ করেন। অতিরিক্ত কথা বলেন, একা একা হাসেন, নিজের সঙ্গে কথা বলেন, ছোটাছুটি করেন, বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নেন ইত্যাদি। মেজাজের পরিবর্তন: এই রোগে দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে রোগীর মেজাজের পরিবর্তন হয়। রোগী অল্পতেই খুশি হন আবার চট করে রেগে যান। অনিদ্রা বা ঘুমের ব্যাঘাত: ক্লান্ত থাকার পরও ঘুমাতে পারেন না রোগী। অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং বারবার ঘুম ভেঙে যায়। পোস্টপার্টাম সাইকোসিস কেন হয় শরীরে হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভে সন্তানধারণ থেকে প্রসব ও প্রসবপরবর্তী সময়ে মায়ের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হতে থাকে। এর প্রভাব পড়ে মনমানসিকতায়। এ থেকে হয় বেবি ব্লু। তা থেকে অনেকে সামলে উঠলেও অনেকেই চলে যান ডিপ্রেশনে। এই ডিপ্রেশন বাড়তে বাড়তে একসময় রূপ নেয় সাইকোসিসে। অপরিকল্পিত সন্তানধারণ: সন্তান নেওয়ার জন্য মায়ের মানসিক প্রস্তুতি ও ইচ্ছা থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই রোগে আক্রান্ত নারীদের বেশির ভাগের বেলায় দেখা গেছে যে তাঁরা অপরিকল্পিতভাবে সন্তান ধারণ করেছেন। পারিবারিক সমর্থনের অভাব: সন্তান প্রসবের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে এক নারী বলছিলেন, প্রথমবার মা হওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সন্তানকে নিয়ে কদিনের জন্য মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শ্বশুড়বাড়ির লোকজন যেতে দেননি। আবার শিশুকে সামলাতেও সাহায্য করেননি কেউ। তার ওপর শিশুকে ঠিকমতো সামলাতে পারেন না বলে তাঁকে দোষারোপ করা হতো। এসব কারণে সন্তানের ওপর রাগ হতো ওই নারীর। আঘাত করতে ইচ্ছা করত ছোট্ট শিশুটিকে। পরমুহূর্তেই বুঝতেন, কিছু একটা ঠিক নেই। তিনি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন যে তাঁর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হয়েছে। চিকিৎসক বলেন, মায়ের প্রতি পরিবারের সদস্যদের খারাপ আচরণ মায়ের মনে সন্তানের প্রতিও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে। এই অবস্থা বেড়ে মানসিক ব্যাধিতে রূপ নিতে পারে। প্রসবপূর্ব বিষণ্নতা: সন্তানধারণের আগে থেকে যদি কেউ বিষণ্নতা বা হতাশায় ভোগেন, তাহলে গর্ভাবস্থায় তা দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যেতে পারে। প্রসবকালীন ট্রমা: অনেক সময় প্রসবকালীন তীব্র ব্যথার অনুভূতি মায়ের মনে আঘাত সৃষ্টি করে। এই ট্রমা থেকেও মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। অতীতে পাওয়া মানসিক আঘাত: ছোটবেলার কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা বা অতীতে কোনো শারীরিক বা মানসিক আঘাতের শিকার হলে সন্তান হওয়ায় সময় বা পরে সেই আঘাতে সৃষ্ট পুরোনো মানসিক ক্ষত ফিরে আসতে পারে। এ থেকেও মায়ের পোস্টপার্টাম সাইকোসিস হতে পারে। পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের প্রতিকার ও চিকিৎসা সন্তান জন্মদানের কোনো সহজ প্রক্রিয়া নেই। মায়ের শরীর-মন সবকিছুর ওপর দিয়েই ধকল যায়। এরপর নবজাতককে লালনপালনের দায়িত্ব তো আছেই। ক্লান্ত মা তাঁর চারপাশে তাকান সাহায্যের খোঁজে। মায়ের বেবি ব্লু যেন হতাশা বা সাইকোসিসে রূপ না নেয়, এর জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে তাঁর পরিবারকে। মাকে সহানুভূতির চোখে দেখতে হবে। তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। তাঁকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে হবে। সন্তান প্রসবের পর পোস্টন্যাটাল বা প্রসবপরবর্তী সেবায় শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। এ নিয়ে কোনো রকম দ্বিধা করা যাবে না। মাকে মানসিকভাবে সুস্থ মনে না হলে প্রয়োজনে চিকিৎসা নিতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত যেকোনো দুর্ঘটনা এড়াতে পরিবারের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। প্রয়োজনে সন্তান প্রতিপালনের জন্য মায়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক একজনকে থাকতে হবে। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা সাইকোসিসের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রশিক্ষিত মনোবিদের কাছে যেতে হবে। যথাযথ চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংও খুবই জরুরি। অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বললেন, ‘মেয়েরা মা হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের সবার কাজ হচ্ছে, মা হওয়ার এই কঠিন যাত্রাকে মায়ের জন্য একটু সহজ করে তোলা। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেকোনো মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় খোলাখুলি আলোচনা করার জায়গা তৈরি করা দরকার।’ অধ্যাপক ফেরদৌসী আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে সন্তানের জন্মের পর মায়ের শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠায় গুরুত্ব দিলেও মানসিক সুস্থতার বিষয়টি এড়িয়া যাওয়ার প্রবণতা এখনো প্রবল। মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না, এ নিয়ে কেউ যেন ভাবতেই চান না। পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ার পর বুঝতে পারেন। কিন্তু, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই সন্তানের জন্মের পর শিশুর পাশাপাশি মায়েরও যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে লালনপালনের কাজে তাঁকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে হবে। তাঁর এই কঠিন সময়কে আরও কঠিন করে তোলা যাবে না।’ |
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
