|
মাইক্রোগ্রিনস 'সুপার ফুড' কী, নিজেই যেভাবে চাষ করবেন
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() মাইক্রোগ্রিনস 'সুপার ফুড' কী, নিজেই যেভাবে চাষ করবেন কৃষি উৎপাদন বাড়াতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার খাদ্যের পুষ্টিগুণ কমিয়ে দিচ্ছে। কৃষি গবেষক ও পুষ্টিবিদদের এমন আলোচনার মধ্যেই ব্যক্তি পর্যায়ে এই সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হয়ে সামনে এসেছে মাইক্রোগ্রিনস। কোনোরকম রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই ঘরোয়াভাবে মাইক্রোগ্রিনস উৎপাদন করা যায়। এটি পরিপক্ব শাকসবজির চেয়েও প্রায় চার গুণ পর্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ বলে জানান পুষ্টিবিদরা। তাদের মতে, মাইক্রোগ্রিনস অবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন, কোষ্টকাঠিন্য, গ্যাস্ট্রিকসহ নানা রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া মানুষের শরীরে আয়রন ও পটাশিয়ামের চাহিদাও পূরণ করতে পারে মাইক্রোগ্রিনস। চুল পড়ার সমস্যা ও রক্ত স্বল্পতা নিরসণেও এটি কার্যকর। পরিপূর্ণ সবজির তুলনায় মাইক্রোগ্রিনসে ভিটামিন সি, ই, কে ও বিটা ক্যারোটিন বেশি পরিমাণে থাকে। অধিক পুষ্টিগুণের কারণে মাইক্রোগ্রিনকে বলা হয় 'সুপার ফুড'। খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে গোটা বিশ্ব। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়তনের অধিক জনসংখ্যার দেশগুলোতে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল আকার ধারন করছে। এমন বাস্তবতায় ঘরোয়া পর্যায়ে স্বল্প পরিসরে কৃষি উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে মাইক্রোগ্রিনসের মাধ্যমে। বাড়ির বারান্দা বা ছাদে যে কোনো জায়গায়, ট্রে বা ভাঙা বোতলের মতো পাত্রে সহজেই উৎপাদন করা যায় এই অর্গানিক সবজি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, যারা সীমিত জায়গায় চাষ করতে চায়, তাদের জন্য এটি একটি মূল্যবান ফসল। "আমাদের ফসলি জমি দিন দিন কমছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে জমিতে রাসায়নিকের ব্যবহারও বাড়ছে, যাতে খাদ্যের পুষ্টিমান অনেক কমে যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি পর্যায়ে স্প্রাউট অথবা মাইক্রোগ্রিনসের উৎপাদন বেশ সহায়ক একটি উপায় হতে পারে," বলেন তিনি। যদিও এটি উৎপাদনে যেসব উপাদান প্রয়োজন সেগুলো কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় বাংলাদেশে এর প্রচলন এখনো খুব একটা হয়নি বলেও মনে করেন তিনি। মাইক্রোগ্রিনস কী? মাইক্রোগ্রিনস, যাকে মাইক্রোভেজিটেবল, মাইক্রোলিফি, মাইক্রোগ্রাস বা মাইক্রোপ্ল্যান্টও বলা হয়। ভোজ্য উদ্ভিদ যা তাদের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়, তখন এটাকে এসব নামে ডাকা হয়। ঠিক যখন বীজপত্র (বীজ থেকে প্রথম পাতা বের হওয়া) সম্পূর্ণরূপে গঠিত হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, মাইক্রোগ্রিনস হলো সাত থেকে আটদিন বয়সের শাকসবজির চারা। সাধারণত একটি বীজ থেকে তিন থেকে চারদিন পর বের হয় স্প্রাউটস্, এরপরের ধাপটিই হলো মাইক্রোগ্রিনস। এভাবে ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করে যা পরিপক্ক আকারে বাজারে বিক্রি করা হয়। যেকোনো শাকসবজির (যেমন- লালশাক, মুলা, লেটুস, বাধাকপি, ব্রকোলি) বীজ একটি ট্রে বা বাটিতে তৈরি বিজতলায় ছিঠিয়ে দিলে সাত থেকে দশ দিনের মাথায় যখন অঙ্কুরিত হয়, তখনই সেটিকে মাইক্রোগ্রিন বলা হয়। এই চারাগাছ এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ বয়সেই কাঁচা খেতে হয়। সাধারণ সবজিতে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়, মাইক্রোগ্রিনে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, এ পুষ্টির পরিমাণ চারগুণ পর্যন্ত বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় আশির দশকে মাইক্রোগ্রিনের ব্যবহার শুরু হয়েছিল মূলত হোটেল, রেস্তোরায় খাবারের সৌন্দর্য এবং স্বাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা আনতে। উচ্চ পুষ্টিগুণের কারণে যা পরবর্তীতে ইউরোপেও ব্যাপকভাব ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে মাইক্রোগ্রিনসের আগমন খুব বেশি পুরনো নয়। করোনা মহামারির পর থেকে এটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে শুরু করে। বিশেষ করে ওয়াটার অ্যান্ড প্লান্ট নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে বাংলাদেশের মাইক্রোগ্রিন নিয়ে বাণিজ্যিক পর্যায়ে কাজ শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা রিফাত খান তুষার বিবিসি বাংলাকে বলেন, "স্বল্প পরিসরে নিজের মতো করে উৎপাদন করার সুযোগ যা আমাদের পুষ্টিচাহিদা পূরণ করবে- মূলত এই চিন্তা থেকেই মাইক্রোগ্রিন মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি আমরা।" মি. তুষার বলছেন, মাইক্রোগ্রিনস উৎপাদন খুবই সহজ এবং কম সময়সাপেক্ষ। এটি বারান্দায় বা ছাদে যে কোনো জায়গায় বা পাত্রে সহজেই চাষ করা সম্ভব। তবে, "যে পাত্রে এটি উৎপাদন করা হবে সেটি ফুড গ্রেড বা খাদ্য উৎপাদনে মানসম্পন্ন হলে ভালো," বলেন তিনি। নিজেই যেভাবে চাষ করবেন বাড়তি ফসল উৎপাদনের চেষ্টায় সার বা কিটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং হাইব্রিড শাক-সবজি অনেক সময় মানুষের শরীরে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে বেড়েছে অর্গানিক খাবারের চাহিদা। এমনকি বাজার নির্ভরতা কমিয়ে অনেকে আধুনিক উপায়ে বাড়ির আঙিনায় নিজেরাই সবজি উৎপাদনের চেষ্টা করছেন। কৃষি উদ্যোক্তা রিফাত খান তুষার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, দ্রুত বর্ধনশীল যেকোনো সবজিই মাইক্রোগ্রিনসের জন্য আদর্শ। তবে সব বীজ একইভাবে বা একই সময়ে অঙ্কুরিত হয় না। সূর্যমুখী বা মুলার বীজকে এক রাত ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরিত হয় দ্রুত; ছোট বীজগুলোকে সাবধানে ভেজানোর পর মাটিতে ছিটিয়ে দিতে হয়, জানান তিনি। মি. তুষার বলছেন, সফলভাবে মাইক্রোগ্রিনস উৎপাদনের ক্ষেত্রে শুরুতেই সঠিক উপকরণ এবং বীজ নির্বাচন করা জরুরি। কোন ধরনের সবজির মাইক্রোগ্রিনস উৎপাদন করতে চান এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং কোন ধরনের পাত্রে উৎপাদন করা হবে সেটিও বাছাই করতে হবে। মাইক্রোগ্রিনস উৎপাদনে রাসায়নিক সার ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। ট্রে বা অন্য কোনো পাত্রে দুই ইঞ্চির মতো মাটির স্তরের সঙ্গে নারকেলের আঁশ কম্পোস্ট করে একটি বিশেষ মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এরপর ভালো করে ভিজিয়ে ঘনভাবে মাটির ওপর বীজগুলো ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর মাটির আরেকটি স্তর দিয়ে বীজগুলোকে ঢেকে রাখতে হবে। গভীরভাবে পুঁতে রাখার প্রয়োজন নেই। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ছিদ্রযুক্ত একটি সমতল ট্রে ব্যবহার করা ভালো। এক্ষেত্রে পানি যাতে জমে না থাকে সেজন্য সরাসরি পানি না দিয়ে ওয়াটার স্প্রে ব্যবহারের কথা বলছেন মি. তুষার। নতুনদের জন্য মাইক্রোগ্রিনস উৎপাদনে সবচেয়ে সহায়ক হতে পারে সূর্যমুখী, মূলা, মটরশুঁটি এবং সরিষার বীজ। কারণ এগুলো সাধারণত দ্রুত অঙ্কুরিত হয়। মাইক্রোগ্রিনস উৎপাদন ব্যয়সাপেক্ষ কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মি. তুষার বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটি যেহেতু বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই করতে হয় তাই প্রাথমিক পর্যায়ে এখানে কিছু বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। তবে সেটি অতিরিক্ত নয় বলেই মনে করেন তিনি। তার মতে, "মাইক্রোগ্রিনের সব থেকে ভালো দিক হলো, এটি উৎপাদনে কোনো রকম পেস্টিসাইড প্রয়োজন হয় না, রাসায়নিক সার প্রয়োজন হয় না, শুধু পানির ওপর নির্ভর করে বীজে যতটুকু পুষ্টিমান থাকে তার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়"। খুবই সাধারণ পদ্ধতিতে উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই খাবারের ব্যপক চাহিদা রয়েছে ইউরোপ আমেরিকায়। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে এর চাহিদা বাড়ছে বলেও জানান তিনি। এর আরেকটি সুবিধা হলো, এটি সব আবহাওয়ায় জন্মায়। তবে তীব্র গরমে কিছুটা বেশি পানি স্প্রে করতে হয় বলে জানান মি. তুষার। পুষ্টিগুণ এবং রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা কৃষি গবেষক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, মাইক্রোগ্রিনসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পলিফেনল এবং গ্লুকোসিনোলেটের মতো যৌগ রয়েছে। সাধারণ সবজির চেয়ে এতে পুষ্টির পরিমাণ বেশি, যার ফলে একে বিশ্বব্যাপি 'সুপার ফুড' হিসেবেও পরিচিত। নিজের গবেষণায়, মাইক্রোগ্রিনসকে ছোট কিন্তু শক্তিশালী খাবার বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্যান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক ডি জিওইয়া। তার মতে, মাইক্রোগ্রিনসগুলো ট্রেন্ডি সবজি থেকে কার্যকরী খাবারে পরিণত হয়েছে যা ভোক্তা নিজেই তার রান্নাঘরের যেকোনো সাধারণ পাত্র ব্যবহার করে সহজেই উৎপাদন করতে পারেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলছেন, ইউরোপ আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই মাইক্রোগ্রিনস খাওয়ার প্রচলন শুরু হলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন এখনো হয়নি। "মাইক্রোগ্রিনস চাষের উদ্দেশ্য কিন্তু ভরপেট খাওয়া নয়, ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করা। কেননা, সাধারণ সবজিতে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়, মাইক্রোগ্রিনসে তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যায়," বলেন তিনি। মাইক্রোগ্রিনসে যে মাত্রায় ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেলস থাকে সেটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বলে মনে করেন পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিফ ডায়েটিশিয়ান নিশাত শারমিন নিশি। তিনি বলছেন, "লিভার ডিটক্সিফিকেশনের ক্ষেত্রে এটি খুবই উপকারী। এছাড়া কোষ্টকাঠিন্য, এনিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা এবং চুল পড়ার সমস্যা নিরসনেও ভূমিকা রাখতে পারে মাইক্রোগ্রিনস।" তবে মাইক্রোগ্রিনস হাই-প্রোটিন যুক্ত খাবার হওয়ায় শিশুদের এটি না খাওয়ানোই উচিত। এছাড়া পটাশিয়াম ও আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকায় যাদের হার্টের সমস্যা বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই খাওয়া উচিত বলেও জানান নিশাত শারমিন নিশি। |
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
