|
কী আছে গ্রিনল্যান্ডের বরফের নিচে
নতুন সময় ডেস্ক
|
![]() কী আছে গ্রিনল্যান্ডের বরফের নিচে গ্রিনল্যান্ড আজ এক জটিল ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে—একদিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন, অন্যদিকে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি। যেমন বলেছিলেন ক্যাথরিন গুডএনাফ, ‘এই দ্বীপের পাথরগুলো শুধু খনিজই ধারণ করে না,বরং মানবসভ্যতার লোভ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দ্বন্দ্বের গল্প বলে।’ গ্রিনল্যান্ড—বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ। যার ৮০ শতাংশই ঢেকে আছে হিমবাহের স্তূপে। কিন্তু এই বরফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সম্পদের সন্ধানে গত এক শতাব্দী ধরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মহল। বিরল মৃত্তিকা খনিজ, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে শুরু করে সবুজ প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য খনিজের সম্ভাবনা থাকায় সবার চোখ গ্রিনল্যান্ডের দিকে। গ্রিনল্যান্ডের মোহনা শুরু হয়েছিল এক হাজার বছর আগে। যখন এরিক দ্য রেড নামের এক ভাইকিং নাবিক এখানে প্রথম ইউরোপীয় বসতি গড়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর জন্য কৌশলগত ঘাঁটি ছিল এই দ্বীপ। আর এখন? ট্রাম্প প্রশাসন থেকে চীন—সবাই এই বরফাচ্ছাদিত ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়ে আছে লোভের দৃষ্টিতে। ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক সার্ভের প্রধান ভূতত্ত্ববিদ ক্যাথরিন গুডএনাফের কথায়, ‘গ্রিনল্যান্ডের ইতিহাস পৃথিবীর প্রাচীনতম ইতিহাসের সমান্তরাল। এখানকার পাথরগুলো মহাদেশীয় বিচ্ছিন্নতা, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে শুরু করে বরফ যুগের গল্প বলে। মজার ব্যাপার হলো, মানচিত্রে গ্রিনল্যান্ডকে আফ্রিকার কাছাকাছি আকারে দেখালেও বাস্তবে এর আয়তন কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের সমান। মেরকেটর প্রজেকশনের বিভ্রম কাটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই দ্বীপের ২০ শতাংশই বরফমুক্ত—যেখানে রয়েছে খাড়া পাহাড়, ফিয়র্ড-কাটা উপকূল আর বর্ণিল ঘরবাড়ি। ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের ভূতাত্ত্বিক সার্ভের সিনিয়র গবেষক থমাস ফিন্ড কোকফেল্টের মতে, উত্তর-পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের অনাবিষ্কৃত অঞ্চলগুলো ১৩০ বছর আগেও ভূতত্ত্ববিদদের জন্য রোমাঞ্চকর ছিল। এখনো সেখানে ম্যাপিংয়ের কাজ অসম্পূর্ণ। খনিজ সম্পদের দিক থেকে গ্রিনল্যান্ডকে 'ক্যাডবেরি ক্রিম এগ'-এর সঙ্গে তুলনা করেন বিশেষজ্ঞরা। ঠিক যেন বাইরের শক্ত খোলসের নিচে সাদা স্রোতের মতো হিমবাহ, আর তার তলায় লুকানো সম্পদ। ১৮৫০ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম গ্রিনল্যান্ডে ক্রায়োলাইট নামক এক খনিজের সন্ধান মেলে, যা অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিমান তৈরিতে এই খনিজ ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সম্পদ হলো রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (আরইই), যা ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি, সোলার প্যানেল থেকে শুরু করে ড্রোন প্রযুক্তিতে অপরিহার্য। সমস্যা হলো, এই খনিজ উত্তোলন সহজ নয়। নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ভূতত্ত্বের অধ্যাপক সাইমন জোউইট স্পষ্ট করে বলেন, প্রতি ১০০টি খনিজ অনুসন্ধান প্রকল্পের মধ্যে মাত্র একটি খনিতে পরিণত হয়। আর সেখান থেকে উৎপাদন শুরু করতে গড়ে ১০ বছর লাগে—অবস্থান, অবকাঠামো, পরিবেশগত অনুমোদনের মতো জটিলতায় ভরা এই প্রক্রিয়া। গ্রিনল্যান্ডে রাস্তা বা রেললাইন নেই বললেই চলে। নৌকা বা হেলিকপ্টার ছাড়া চলাচল প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া, বিরল মৃত্তিকা খনিজগুলো প্রায়শই ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থের সঙ্গে জড়িত। ২০২১ সালে গ্রিনল্যান্ড সরকার ইউরেনিয়ামের মাত্রা সীমিত করার আইন পাস করায় দক্ষিণাঞ্চলের একটি খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশগত ঝুঁকিও কম নয়। গ্রিনল্যান্ডের তিনটি পুরনো খনি থেকে নির্গত বর্জ্যে উপকূলের পানিতে ভারী ধাতুর মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অ্যালবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান মেরিল্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, ‘৫০ বছর পরও লাইকেন, মাছ বা শামুকের দেহে সিসা, আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত পদার্থ মিলছে। গ্রিনল্যান্ডের ঠান্ডা পানি ও লবণাক্ততার স্বল্পতা প্রকৃতির স্বাভাবিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে।’ তিনি সতর্ক করেন, জলজ ব্যবস্থার ক্ষতি মানে গ্রিনল্যান্ডবাসীর মৎস্য আহরণ ও শিকারের ভিত্তি ধ্বংস করা। জলবায়ু পরিবর্তন এই অঞ্চলে বিশ্বের চেয়ে চার গুণ দ্রুত ঘটছে। গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ প্রতি ঘণ্টায় ৩০ মিলিয়ন টন বরফ হারাচ্ছে। তবে মেরিল্ডের মতে, ‘হিমবাহ গললে নতুন ভূখণ্ড উন্মোচিত হবে, কিন্তু তা এখনো খনির জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। এই প্রক্রিয়া শতাব্দীর ব্যাপার।’ বরং আর্কটিক সমুদ্রপথে বরফ হ্রাস খনিজ পরিবহনকে সহজ করছে, যা জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তৈরিতে সাহায্য করবে। গ্রিনল্যান্ডবাসীরা খনিকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হিসেবে দেখলেও ভয়ও কম নেই। এখানে জমির মালিকানা সরকারের হাতে, কিন্তু স্থানীয়রা মনে করেন—‘জমি সবার, আবার কারো নয়।’মেরিল্ডের ভাষ্যে, ’খনি স্থাপনে স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা জরুরি। তারা প্রকল্পের সহ-মালিকানা ও পরিকল্পনায় অংশ নিতে চান।’ ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের কথায়, ‘গ্রিনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এর মানুষ। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ কি সেই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে না? গ্রিনল্যান্ড আজ এক জটিল ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে—একদিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন, অন্যদিকে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি। যেমন বলেছিলেন ক্যাথরিন গুডএনাফ, ‘এই দ্বীপের পাথরগুলো শুধু খনিজই ধারণ করে না,বরং মানবসভ্যতার লোভ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দ্বন্দ্বের গল্প বলে।’ বরফের নিচে লুকানো সম্পদ হয়তো বিশ্বকে এগিয়ে নেবে, কিন্তু এর মূল্য কতটা—তা এখনো অনিশ্চিত। |
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
