মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা ও পরবর্তী উত্থান
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা ও পরবর্তী উত্থান একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে একটি রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়। পরে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেখানে একাত্তরের ভূমিকার জন্য দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণারও আবেদন করা হয়। কিন্তু ওই বছর অক্টোবরে বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে মারা যান জামায়াতগুরু গোলাম আযম। ফলে সুপ্রিমকোর্টে ওই আপিল কার্যকারিতা হারায়, জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদনটিও আর এগোয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তাতে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সে সময় জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল সংবিধানের ৩৮ ধারার ক্ষমতাবলে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তাতে ফের বৈধভাবে রাজনৈতিক কর্মকা-ে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় জামায়াতে ইসলামী। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন। সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭টি আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা। একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও খালেদা জিয়ার চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়াকে লাখো শহীদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় যুদ্ধাপরাধের এক মামলার রায়ে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী। এরপর তারা আর দলীয়ভাবে ভোট করতে পারেনি। সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ‘অবৈধ ও বাতিল’ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে সর্বোচ্চ আদালতেও হাইকোর্টের ওই রায় বহাল থাকে। নিবন্ধন বাতিলের পর জামায়াত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়নি। তবে ২০১৯ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটসঙ্গী বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিয়েছিলেন জামায়াতের কয়েকজন। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে না পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াত নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পাওয়া জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি সেই নব্বইয়ের দশকেই সামনে এসেছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে। ব্যক্তির অপরাধের বিচার হলেও দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি ২০১৩ সালেই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে তোলা হয়েছিল। গোলাম আযমের মামলার রায়ে আদালত জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করার পর দাবিটি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সাত ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল করে। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে এটি দাখিল করা হয়। সে সময় তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেছিলেন, ‘তদন্তে আমরা প্রাথমিকভাবে জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে একাত্তরের নৃশংসতার জন্য অভিযুক্ত করেছি। এ জন্য আমরা তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাসহ কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও অবলুপ্তি চেয়েছি।’ তদন্ত সংস্থা জানায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর সাতটি ধারায় জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গ, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অপরাধ এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। জামায়াতের পাশাপাশি একাত্তরে দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, শান্তি কমিটি (লিয়াজোঁ), রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী (অপারেশনস) এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার (প্রপাগান্ডা) বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হলেও বিচার কার্যক্রম আর এগোয়নি। কারণ সংগঠনের বিচার করার জন্য আইন সংশোধনের প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি আটকে থাকে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ঝুলে থাকে। গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারিয়ে নির্বাচন করার পথ বন্ধ হলেও দল হিসেবে জামায়াত ছিল সক্রিয়। গত নির্বাচনের আগেও দলীয়ভাবে তাদের মিছিল সমাবেশ করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ব্যবহার করে ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। গত সোমবার রাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় দলের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। এরপর গত মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে জানান, নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং বুধবারের (গতকাল) মধ্যেই আদেশ জারি করা হবে। জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। সেখানেও নিষিদ্ধ হয়েছিল এ দল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে প্রথমবার পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৯ সালে। এরপর পাকিস্তানের মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালে দলটিকে আবারো নিষিদ্ধ করা হয়। তবে পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এ দিকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ১৯৭২ সালে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। পরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত। ইসলামী ছাত্রসংঘও নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর অস্তিত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে দলটির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম এখনো রয়েছে। জামায়াত
|
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |