সুদে ডুবছে জেলেপাড়া! নদী থেকে ঘাটে ফিরেই ভেঙে পড়ছে জেলেদ স্বপ্ন
মো. আমিনুল ইসলাম ইসলাম
প্রকাশ: Wednesday, 26 November, 2025, 7:10 PM
সুদে ডুবছে জেলেপাড়া! নদী থেকে ঘাটে ফিরেই ভেঙে পড়ছে জেলেদ স্বপ্ন
দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীরে বসবাস করা জেলে পরিবারগুলো এক কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। নদীতে ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরলেও ঘাটে ফিরে তাদের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। কারণ তাদের রক্ত–ঘামে অর্জিত টাকার বড় অংশই হারিয়ে যায় দাদনের সুদের বোঝায়। আর এভাবেই সুদের চাপে প্রতিদিনই ডুবে যাচ্ছে পুরো জেলেপাড়া।
ভোরের অন্ধকারে তারা নৌকা নিয়ে ঝুঁকি পেরিয়ে নদীতে নামেন। উত্তাল ঢেউ, স্রোত আর ঝড়ো হাওয়াকে জয় করে যখন জাল তুলে নৌকা ভরেন, তখন মনে আশা জাগে,আজ হয়তো ঘরে খাবার উঠবে। কিন্তু ঘাটে নোঙর করার পর সেই সামান্য আয়রাশিও আর হাতে থাকে না। দাদন–ব্যবসায়ীর লাল খাতাই তাদের আয় গিলে নেয়।প্রতিদিন দিতে হয় দাদনের ১৫% অসহনীয় সুদে ক্ষতবিক্ষত জেলেদের জীবন। দশমিনার বিভিন্ন বাজার দশমিনা সদর, রণগোপালদী, আলীপুর, সুতাবাড়িয়া হাট, পাগলা বাজার, বুড়াগৌরাঙ্গ তীরঘেঁষা ঘাটে,প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে দাদনদারদের আড়ত।
উত্তর বাঁশবাড়িয়া, বগীর খালগোড়া, লঞ্চঘাট, আমবাড়িয়া, হাজিরহাট, গোলখালী, সৈয়দ জাফর, কাঁলারানী, আউলিয়াপুর, পাতারচর, সেন্টার বাজার, পাগলা বাজার ও বউ বাজার,এই নদীতীরের গ্রামগুলোতে জেলেদের জীবন পুরোপুরি নির্ভরশীল মাছের ওপর।
গোলখালী মৎস্য ঘাটের একাদিক জেলেদের অভিযোগদাদন নেওয়ার পর প্রতিদিন দিতে হয় ১৫% পর্যন্ত সুদ, যে মাছ ধরেন, তা অবশ্যই সেই গদিতে বিক্রি করতে হয়।নিলামে ওঠার আগেই গদি মালিক মাছের এক-দশমাংশ সরিয়ে রাখেন। সব হিসাব রাখা হয় কুখ্যাত লাল খাতায়।ফলে জেলেদের আয় যত বাড়ে, দেনা তার চেয়েও বেশি বাড়ে।এক বলে আরেকের কাছ থেকে দাদন না নিলে পুরো মৌসুমেই নদীতে নামা সম্ভব হয় না।
তারা আফসোস করে বলেন, নদীতে মাছ ধরতে যাই। কিন্তু ঘাটে ফিরে দেখি সবই দাদনের। আমাদের কিছুই থাকে না।”
এছারাও মাছ কমে যাওয়ায় আয় কমছে, অথচ সুদের হিসাব বাড়ছেই। ফলে কেউ ঘরের আসবাব বিক্রি করছে, কারও শিশু স্কুল ছেড়ে দিয়েছে,কেউ আবার চিকিৎসা করাতে না পেরে রোগে কষ্ট পাচ্ছে। ফেলে তাদের স্ত্রীরা কিস্তির চাপে মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।কোনো কোনো পরিবার দিনের খাবার জোগাড় করতেই সংগ্রাম করছে।
এদিকে বছরের পর বছর নদীতে জাল ফেলতে ফেলতে জাল জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। পুনঃবুনন করতে লাগে অনেক টাকা।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন,এ এলাকার স্থায়ী আতঙ্ক। এক রাতের ঝড়ে নৌকা বা জাল নষ্ট হলে আবারও দাদনই একমাত্র ভরসা।এই “দেনা,নতুন দেনা”র চক্রই জেলেদের জীবনকে দমবন্ধ অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে।
জেলেদের কষ্ট দেখে একাধিক সেবা মূলক সংগঠনের প্রতিনিধিরা জানান, জেলেদের নৌযান সুরক্ষা,মাছের বাজারে স্বচ্ছতা,সুদবিহীন সরকারি ঋণ,আধুনিক ঘাট নির্মাণ ও জেলেদের জন্য আবাসন এসব সুবিধা নেই বললেই চলে। তাহলে তারা দুর্দশার মধ্যে থাকবে না, তাহলে থাকবে কারা। তাই সরকারের উচিত নদীর তীরবর্তী এলাকার জেলেদের জন্য সঠিক কিছু করা।
গোয়ালখালী মৎস্য কাঠের জেলে ফিরোজ মিয়া বলেন,“উন্নয়ন হয়, কিন্তু আমাদের জীবনে কেনো সেই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে না।কেউ জিজ্ঞেসও করে না।”
সৈয়দ জাফর এলাকার জেলে আবু জাফর বলেন,“জাল ঠিক করতেই দুই–তিন হাজার লাগে। নৌকার কাজ করতে লাগে আরও বেশি। নিজেরা তো টাকা জোগাড় করতে পারি না, তাই বাধ্য হয়ে দাদন নিই।”আর এই একবার দাদনের খাতা খোলার পরই শুরু হয় অবিরাম দেনার জীবন।
স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের দাবি, সরকারিভাবে সুদবিহীন ঋণ দেওয়া, প্রজনন মৌসুমে মাছের সুরক্ষা নিশ্চিত করার, দাদন ব্যবসার ওপর কঠোর নজরদারি থাকা, এবং জেলেদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যকর হলেতবে হয়তো জেলেপাড়ার মানুষ দাদনের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
সুদে ডুবলেও, মাছ কমলেও, ঘাটে স্বপ্ন ভেঙে গেলেও জেলেরা হাল ছাড়েন না।পরদিন ভোরে আবার জাল তুলে নদীতে নামেন।কারণ তাদের বিশ্বাস,একদিন হয়তো নদী উদার হবে, দাদনের খাতা ছিঁড়ে যাবে, আর ফের ঘরে উঠবে হাসি–আনন্দ।