ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
বুধবার ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বিদায়ের আগে শেষ মুহূর্তেও মানবিকতার ছাপ রেখে গেলেন ডিসি জাহিদুল ইসলাম
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Monday, 17 November, 2025, 4:55 PM

বিদায়ের আগে শেষ মুহূর্তেও মানবিকতার ছাপ রেখে গেলেন ডিসি জাহিদুল ইসলাম

বিদায়ের আগে শেষ মুহূর্তেও মানবিকতার ছাপ রেখে গেলেন ডিসি জাহিদুল ইসলাম

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক মানবিক উদ্যোগে দৃষ্টি কাড়ছিলেন সারাদেশে মানবিক ডিসি হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।

রবিবার (১৬ নভেম্বর) তিনি নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আলমগীর হোসেনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নিলেন।

রাজনৈতিক, পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ভিড় জমাতে শুরু করেন। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শত মানুষের সমাগম ঘটে সেসময়। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও বিদায়ী জেলা প্রশাসককে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।

রাতে জেলা প্রশাসকের বাংলোতে আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

সারাদেশে মানবিক জেলা প্রশাসক হিসেবে পরিচিত জাহিদুল ইসলাম মিঞা শেষ মুহূর্তেও রেখে গেলেন মানবিকতার আরেকটি উদাহরণ।

শারীরিক প্রতিবন্ধী দুস্থ এক কবিকে নিজের বাসায় আপ্যায়ন করে তাকে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার উপহার দিয়ে বিদায় নিলেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জ শহরের সালেহনগর এলাকার আলী আহাম্মদ ও রহিমা বেগম দম্পতির ছেলে ইমরান আহম্মেদ (৪৬)।

তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও পেশায় কবি ও লেখক। তার চারটি গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

তার হাত–পা এবং শরীরের প্রায় সব অঙ্গই জন্মগতভাবে বিকল। তার পিতা–মাতা গরিব ও দিনমজুর। অন্যের সাহায্য ছাড়া তিনি চলাফেরা, খাওয়া–দাওয়া সহ দৈনন্দিন কাজ করতে পারছিলেন না। চলাফেরার সুবিধার্থে একটি ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় তা কেনা সম্ভব হয়নি।

বিদায় অনুষ্ঠানের মাঝেও জেলা প্রশাসক তাকে ডেকে পরম মমতায় কুশলাদি বিনিময় করে উপহার দিলেন ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার। তাকে ও তার পরিবারকে রাতের খাবার খাওয়াতেও ভুললেন না জেলা প্রশাসক। বিদায়ী অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিরা শেষ মুহূর্তেও তার এই মানবিক কাজের প্রশংসা করেন।

ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার পেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কবি ইমরান বলেন, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য—এই মহৎ বাণীটা আজ আমার জীবনে বাস্তব সত্য হয়ে ধরা দিল।

তিনি বলেন, তার দৈনন্দিন কাজকর্ম তার বৃদ্ধ মা–বাবার কাঁধে চড়ে করতে হয়। এই দুর্ভোগের কথা ‘মায়ের আঁচল সাহিত্য সামাজিক মৈত্রী পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হারুনুর রশীদ সাগরের মাধ্যমে মানবতার মানুষ হিসেবে পরিচিত জেলা প্রশাসকের কানে পৌঁছে।

বিদায়ী জেলা প্রশাসকের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ডিসি স্যার একজন অভিভাবক ও মানবিক নেতার দায়িত্ববোধ নিয়ে আমার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আজ সেই আশ্বাস বাস্তবে রূপ নিল।

ডিসি স্যার নিজ হাতে আমাকে অত্যাধুনিক একটি ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার উপহার দিলেন। এটি শুধু একটি চেয়ার নয়—এটি আমার জীবনে নতুন আশার দিগন্ত, চলার পথে শক্তি, সাহস ও আলোর প্রদীপ।”

এর আগে দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক বিদায়ের সময় জেলা প্রশাসনের বহু কর্মকর্তা–কর্মচারীর চোখে অশ্রু দেখা যায়। কেউ কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

সংক্ষিপ্ত সময়, অসংখ্য দৃষ্টান্ত—মানবিক ডিসি জাহিদুল ইসলাম আজ সোমবার বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করবেন বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ–আহত পরিবার, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, দুস্থ মানুষ, অসহায় শিশু, কারাবন্দি, ঝুঁকিপূর্ণ রোগী—সবাইয়ের ঠিকানা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোহাগকে স্মার্টফোন, সালমা জেরিনকে ল্যাপটপ; ২০ প্রতিবন্ধীকে হুইলচেয়ার ও ইলেকট্রিক চেয়ার; বিশেষ স্কুলের শিশুদের শিক্ষা উপকরণ; অসহায় আজান, নাছিমা, আলভী, সিরাজুল ও ফয়সালসহ বহু রোগীর চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা—সবখানেই ছিল তার স্পর্শ।

জুলাই শহীদ ২১ পরিবারকে ৪২ লাখ টাকা, আহত ২১২ যোদ্ধাকে অনুদান, এতিমখানার ৮২ শিশুকে পাঞ্জাবি–ইফতার, কারাগারের ১,২৪৪ বন্দির জন্য ক্রিকেট টুর্নামেন্ট—মানবিকতার ছাপ সর্বত্র।

সবচেয়ে আলোচনায় আসে তার গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ কর্মসূচি এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ, যার সুফল জেলাবাসী পাবেন অনেক বছর।

হাসপাতালে নবজাতকের আইসিইউ চালু, খানপুর হাসপাতালে হুইলচেয়ার প্রদান, ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে অত্যাধুনিক সিবিসি–ইসিজি মেশিন, ফুটবল একাডেমির শিশুদের জন্য বল–বুট ও টুর্নামেন্ট খরচ বহন—উন্নয়নেও রেখেছেন ভূমিকা।

এমনকি শতবর্ষী হকার ফজিলাতুন্নেছাকে খাদ্যসামগ্রী ও পুঁজি প্রদান, আর ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করতে না পারায় লাশ আটকে রাখা পিংকির মরদেহ ১৪ ঘণ্টা চেষ্টায় পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়াও তার মানবিকতার অনন্য উদাহরণ।

পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে ফটোসেশনের বদলে নিজ হাতে সিরিঞ্জ কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলা, একদিনে ৩০ জন ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্য লটারিতে বদলি, মাত্র ১১২ টাকায় সরকারি চাকরি—স্বচ্ছতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সিজার বন্ধ হয়ে গেলে জেলা পরিষদ থেকে নতুন ডায়াথার্মি মেশিন উপহার দিয়ে সংকট কাটান। নারী ফুটবলারদের স্বপ্ন পূরণেও পাশে ছিলেন তিনি।

মানুষের সুখ–দুঃখে নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি, দ্রুত সিদ্ধান্ত ও মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করে ডিসি জাহিদুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন “নারায়ণগঞ্জের অভিভাবক” ও অঘোষিত জনপ্রতিনিধি।

এর আগে ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর রাজবাড়ীতে যোগ দিয়েই দ্রুত জনবান্ধব প্রশাসক হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের পরিবার ও আহতদের চিকিৎসা—সবকিছুতেই নির্ভরযোগ্য ঠিকানা ছিলেন তিনি। যোগদানের দুই দিনের মাথায় শহীদদের বাড়িতে ছুটে যাওয়া এবং আহতদের সেবা নিশ্চিত করে সারাদেশে ‘মানবিক ডিসি’ হিসেবে পরিচিতি পান।

শীতের রাতে দরিদ্র মানুষের দরজায় কম্বল বিতরণ, ক্ষতিগ্রস্ত চার হাজার পেঁয়াজ চাষির পাশে দাঁড়ানো, রাজবাড়ী কারাগারের বন্দিদের পুনর্বাসনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই ছিল তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ।

দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় দাতা সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে স্কুল চালু রাখার ব্যবস্থাও করেন তিনি।

১৯৭৯ সালের অক্টোবরে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে জন্ম। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে বড় হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স–মাস্টার্স এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে রাশিয়ান ভাষায় ডিপ্লোমা অর্জন করেন। পরে যুক্তরাজ্য থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমএসসি সম্পন্ন করেন।

২০০৬ সালে ২৫তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসনে যোগ দেন। লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, মৌলভীবাজার ও নোয়াখালী—বিভিন্ন জেলায় এনডিসি, এসিল্যান্ড ও ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমলগঞ্জে ইউএনও থাকাকালে জেলার শ্রেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান।

গতকাল তার আনুষ্ঠানিক বিদায়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ বলেন—বিদায়ী ডিসি জাহিদুল ইসলামকে তারা দীর্ঘদিন মনে রাখবেন তার মানবিকতা, বিনয় ও জনবান্ধব আচরণের জন্য।

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status