|
ডেঙ্গু ছড়ানোর এডিস মশা চিনবেন কীভাবে, সংক্রমণের সময় বদলাচ্ছে, কারণ কী?
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() ডেঙ্গু ছড়ানোর এডিস মশা চিনবেন কীভাবে, সংক্রমণের সময় বদলাচ্ছে, কারণ কী? মশার কারণে অবশ্য আতঙ্কিত না হয়েও উপায় নেই। ছোট্ট এই জীবের কামড়ে প্রতিবছরই অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছেন অনেকে। চলতি বছরেও বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বা আইইডিসিআর এর তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৭ হাজার মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মারা গেছেন ৩০৭ জন। অবশ্য অতীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এর থেকেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপের তীব্রতা দেখা গিয়েছিল। ওই বছর এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে বেশি, প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই বছর মারা গিয়েছিলেন প্রায় দুই হাজার জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলছেন, "ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এডিস মশার নির্মূল করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেই কাজটির আমরা ঠিক মতো করতে পারিনি।" তার মতে, কেবল কীটনাশকের ধোঁয়া ছিটিয়ে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব নয়, প্রয়োজন কমিউনিটি এনগেজমেন্ট বা সাধারণ মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এডিস মশা চেনার উপায় পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। বাংলাদেশে যেসব প্রজাতি বেশি দেখা যায় তার মধ্যে অ্যানোফিলিস, এডিস ও কিউলেক্স এই তিন ধরনের মশাই বেশি ক্ষতিকর। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এডিস মশার কামড়ে ছড়ায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। আর ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের কারণ কিউলেক্স মশার কামড়। ডেঙ্গি বা প্রচলিত ভাষায় ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হলো এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস জাতের মশা। কিটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশা খালি চোখে দেখেই শনাক্ত করা সম্ভব। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল এর তথ্য অনুযায়ী, এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস জাতের মশার দেহে সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে, যে কারণে এটিকে টাইগার মশাও বলা হয়। সাধারণত এই জাতীয় মশা মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। এর অ্যান্টেনা বা শুর দেখতে কিছুটা লোমশ হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা অনুযায়ী, এডিস মশার অ্যান্টেনায় অনেকটা দাড়ির মতো থাকে। পুরুষ মশার অ্যান্টেনা স্ত্রী মশার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি লোমশ দেখতে হয়। দেহের ডোরাকাটা দাগ এবং অ্যান্টেনা দেখে এডিস মশা চেনা সম্ভব বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলছেন, এডিস মশা সাধারণত স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে এবং শহর এলাকার সৌন্দর্যবর্ধক বাগান, পাত্র বা টবে জমে থাকা পানিতে জন্মায়। তবে ২০১৯ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে নোংরা পানিতেও বংশ বিস্তার করতে পারে এই মশা। মি. বাশার বলছেন, অন্যসব প্রাণীর মতো, সময়ের সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মশারও কিছু ধরনগত কিছু পরিবর্তন হয়। "ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ বা ধরন রয়েছে। প্রতি বছর একই ধরনের সংক্রমণ নাও হতে পারে। যেকোনো ভাইরাসই খুব দ্রুত মিউটেশন ঘটায়," বলেন তিনি। বাংলাদেশে এডিস মশা বাংলাদেশে কবে থেকে এডিস মশা আছে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে শহরগুলোতে এর উপস্থিতি প্রথম নজরে আসে আশির দশকে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর। তখন থেকে বাংলাদেশে এডিস মশার উপস্থিতি সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলছেন, অতীতে এডিস মশা থাকলেও ডেঙ্গু টেস্টের তেমন সুযোগ না থাকায় তার অস্তিত্ব নিয়ে এতো বেশি গবেষণা বা চিন্তার সুযোগ ছিল না। ১৯৯৮ সালে কিছু রোগীর দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস ধরা পড়ে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর অনেক রোগীর দেহে ডেঙ্গুর জীবাণু পাওয়া যায়, ২০০০ সালের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপও কিছুটা বাড়ে। তখন থেকেই মূলত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কী করা যেতে পারে এই বিষয়ে গবেষণা ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়েও নানা সচেতনতামূলক প্রচারণা একটু একটু করে শুরু হয়। আইইডিসিআর এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রকট আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। সেই বছর এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, এবং মারা যায় ১৭৯ জন। এরপর ২০২৩ সালে ইতিহাসের সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, "আগে কেবল শহর এলাকায় এডিস মশার প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও বর্তমানে নগরায়নের প্রভাবে গ্রামেও এটি পৌঁছে গেছে।" প্রাণঘাতী মাস হচ্ছে নভেম্বর ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর মাস ছিল আগস্ট। এই মাসে গড় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮ দশমিক ৮। এ সময়টায় নভেম্বর মাসে গড় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ দশমিক ৯। তবে ২০২১ সালের পর বাংলাদেশে ডেঙ্গু-সম্পর্কিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে নভেম্বর মাসটি সবচেয়ে প্রাণঘাতী মাসে পরিণত হয়েছে। গড় হিসাবে নভেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে ১৮৬ দশমিক ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যেখানে অক্টোবর মাসে এই সংখ্যা ১৬৪ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৬। এখন আগস্ট মাসে গড় মৃত্যুর হার ১০৪ দশমিক ৭। নাজমুল হায়দার বলেন, ‘ঋতু, প্রবণতা এবং রোগের ধরনের পরিবর্তন ডেঙ্গুর মতো রোগের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে মহামারির পর ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ এবং এর ঋতুভিত্তিক প্রকৃতিতে পরিবর্তন দেখা গেছে। অক্টোবর মাসে (বর্ষার শেষের দিকে) সর্বাধিক রোগী শনাক্ত হয়, কিন্তু নভেম্বর মাসে (শীত ঋতু ঘনিয়ে আসার সময়) সর্বাধিক মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ, কারণ উদ্ঘাটন এবং মোকাবিলা করার জন্য আমরা প্রস্তুত কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।’
|
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
