|
গাজীপুরের শ্রীপুরে মক্কা মেসফালাহ্ বিএনপি সভাপতি ও ৬ সহযোগী অস্ত্রসহ গ্রেফতার
ফাহিম ফরহাদ, গাজীপুর
|
![]() গাজীপুরের শ্রীপুরে মক্কা মেসফালাহ্ বিএনপি সভাপতি ও ৬ সহযোগী অস্ত্রসহ গ্রেফতার বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) ভোরে যৌথবাহিনীর অভিযানে তাকে ও তার ছয় সহযোগীকে আটক করা হয়। বুধবার রাত আড়াইটা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত চলে সিনেমাটিক এই বাস্তব অভিযান। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের বরকুল গ্রামের তার বাড়িকে ঘিরে চলে এই অভিযান, যা কয়েক ঘণ্টা ধরে টানটান উত্তেজনার সৃষ্টি করে স্থানীয়দের মধ্যে আবিষ্কৃত হয় অন্ধকার এক অধ্যায়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এনামুল হক মোল্লার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ ছিল অস্ত্র ব্যবসা, ভয়ভীতি, জমি দখল ও স্থানীয় রাজনীতিতে সন্ত্রাসী প্রভাব বিস্তারের। বিদেশ থেকে ফিরে এসে তিনি রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজর ছিল তার ওপর। কিন্তু বুধবার রাতে পাওয়া গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অবশেষে যৌথবাহিনী তার বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযান শেষে শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জুনায়েদ জানান, “গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে আমরা এনামুল হক মোল্লাকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করি। পরবর্তীতে তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তার সাত সহযোগীকেও আটক করা হয়।” অভিযান শেষে উদ্ধার করে জব্দ করা হয় দুটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি ম্যাগাজিন, চার রাউন্ড গুলি, চারটি ওয়াকিটকি, চারটি পুলিশি ব্যাটন, দুটি ইলেকট্রিক শর্ট মেশিন, একটি হ্যামার নেল গান ও একটি ধারালো চাকু। এসব অস্ত্র ও সরঞ্জাম কোথা থেকে এসেছে, কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতো — তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্থানীয়রা জানান, এনামুল হক মোল্লা বরমী এলাকায় একসময় ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করলেও পরে তার প্রভাব ও আর্থিক অবস্থার কারণে ধীরে ধীরে এলাকায় একধরনের ভয়ভীতি ও ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে। কেউ তার বিরোধিতা করলে হুমকি ও ভয়ভিতি প্রদর্শন করা হতো। আবার কেউ কেউ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় তিনি নাম পরিবর্তন করে ‘আব্দুল্লাহ আল মামুন’ নামে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি নিজেকে “মক্কা মেসফালাহ্ সৌদি আরব বিএনপির সভাপতি” পরিচয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে থাকেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন, প্রভাব বিস্তার করেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক প্রচারণাও চালান। দীর্ঘ সাত বছর পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি হঠাৎই দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর তিনি যেন সিনেমার চরিত্রের মতো আলোচনায় আসেন—হেলিকপ্টারে বরমী গ্রামের আকাশে ঘুরে বেড়িয়ে নাটকীয়ভাবে নিজ বাড়িতে নামেন। ওই দিন পুরো গ্রামজুড়ে তার আগমন নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। মানুষ তখন বুঝতেও পারেনি, যিনি বিদেশে নাম বদলে ছিলেন, তিনি আবার আগের নামেই দেশে ফিরে রাজনৈতিক মঞ্চে সক্রিয় হতে যাচ্ছেন। ![]() গাজীপুরের শ্রীপুরে মক্কা মেসফালাহ্ বিএনপি সভাপতি ও ৬ সহযোগী অস্ত্রসহ গ্রেফতার কিন্তু ধীরে ধীরে তার অতীতের ছায়া ফের ঘনিয়ে আসে। এলাকায় তার পুরনো অপরাধচক্রের সদস্যরা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠতে থাকেন তারই ছত্রছায়ায়। ব্যবসায়ী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ তার পুনরায় উত্থান নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। স্থানীয়দের অভিযোগ, “সে বিদেশে থেকেও এলাকার লোকজনকে ভয় দেখাত। ফিরে এসে আবার পুরনো দলবল নিয়ে সক্রিয় হয়েছে।” গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এনামুলের বিদেশি সংযোগও ছিল। তার বিরুদ্ধে সন্দেহ রয়েছে, প্রবাসে অর্জিত অর্থ দেশে এনে অস্ত্র কেনা ও রাজনৈতিক তৎপরতার জন্য ব্যবহার করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, “সে নিজেকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তুলে ধরলেও, মূলত নির্বাচনের আগে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্যই এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল।” অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা জানান, এনামুলের বাড়িতে ঢোকার সময় তারা বেশ প্রতিরোধের মুখে পড়েন। বাড়িটি যেন ছোট এক দুর্গের মতো সাজানো ছিল। দেয়াল ঘেরা, সিসিটিভিতে পর্যবেক্ষণ করা হতো বাইরের চলাচল। তল্লাশিতে দেখা যায়, বাড়ির ভিতরেই অস্ত্র রাখার গোপন কক্ষ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্র তার রাজনৈতিক শোডাউন ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর কাজে ব্যবহার হতো। এলাকাবাসীর ভাষায়, “এনামুলের বাড়িতে লোকজন সারাক্ষণ আসা-যাওয়া করত। অনেকেই সন্দেহ করত, এখানে কিছু অস্বাভাবিক চলছে।” গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আবদুল হান্নান বলেন, “সে সৌদি থেকে এসে নিজেকে বড় নেতা হিসেবে দাবি করত। কিন্তু আমরা জানতাম, তার অতীত ভালো নয়। রাতে মাঝে মাঝে গাড়ি আসত, কেউ জানত না ভেতরে কী হয়।” অভিযান শেষে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। বরমী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রতন বলেন, “আমরা বহুদিন ধরে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে আসছিলাম। অবশেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সফল অভিযানে এলাকার মানুষের মাঝে এখন স্বস্তি ফিরেছে।” অপরদিকে, বিএনপি নেতারা বলছেন, এনামুল হক মোল্লা দলের কেউ নন। বিএনপি নির্বাহী কমিটির সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. এস এম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, “এনামুল হক মোল্লা একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। ২০০১ সালে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সে দলের নাম ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।” আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এনামুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা প্রক্রিয়াধীন। শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল বারিক জানান, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে অস্ত্র রাখার বিষয়টি স্বীকার করেছে। তবে এর পেছনে কারা অর্থ দিয়ে বা বিভিন্ন ভাবে তাকে প্রভাবিত করেছে তা বের করতে তদন্ত চলছে।” গাজীপুর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা মনে করছি, এনামুল হক মোল্লা শুধু স্থানীয় সন্ত্রাসী নয়, বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের অংশ। তার পেছনে কারা তাকে সহযোগিতা করেছে, কারা বিদেশে থেকে অর্থ পাঠিয়েছে— সব দিকেই আমরা নজর দিচ্ছি।” এ ঘটনার পর বরমী ইউনিয়নে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টহল জোরদার করেছে। এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এনামুলের গ্রেফতার শুধু একজন অপরাধীর পতন নয়, বরং রাজনীতির নামে অপরাধের ব্যবসায় লিপ্ত এক শ্রেণির মানুষের মুখোশ উন্মোচনও বটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মো. আতিকুল্লাহ বলেন, “বাংলাদেশে প্রবাসফেরত অনেকেই রাজনীতির নাম ব্যবহার করে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন। তারা অর্থবল ও প্রবাসী পরিচয় কাজে লাগিয়ে প্রভাব খাটিয়ে অপকর্মে লিপ্ত হন। এনামুল হক মোল্লার ঘটনা তার জ্বলন্ত এক উদাহরণ।” তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের অপরাধীরা রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকেও এসব বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে এবং নেতাদের কর্মকাণ্ডে নজর দেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।” অভিযান শেষে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, এনামুল হক মোল্লার কাছ থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্য জড়িতদেরও গ্রেফতারের অভিযান চলছে। এই ঘটনাটি শুধু একটি ব্যক্তির গ্রেফতার নয়, বরং রাজনীতি ও অপরাধের জটিল সম্পর্কের একটি বড় উদাহরণ হিসেবে ইতোমধ্যে সামনে এসে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বরমীর মানুষ এখন বলছে— “দীর্ঘদিন পর আমরা শান্তি পেয়েছি।” অভিযানে এমন অপরাধী গ্রেফতারে প্রমাণ করেছে, অপরাধ বা অপরাধীরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, আইনের কাছে সবাই সমান। অপরাধ ও অপরাধী চক্র যতই ক্ষমতাবান কিংবা প্রভাবশালী হোক না কেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের দমাতে সক্ষম। রাজনৈতিক পরিচয়, বিদেশফেরত ভাব বা অর্থবল— কিছুই শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারে না কোন অপরাধীকে। |
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
