ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
বুধবার ৮ অক্টোবর ২০২৫ ২৩ আশ্বিন ১৪৩২
পাপড়ির আড়ালে বিষ: ফুলের মালায় ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Wednesday, 8 October, 2025, 2:10 PM

পাপড়ির আড়ালে বিষ: ফুলের মালায় ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম

পাপড়ির আড়ালে বিষ: ফুলের মালায় ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম

উৎসব, অভ্যর্থনা বা বিশেষ অনুষ্ঠানে ফুলের তোড়া ও মালার ব্যবহার প্রচলিত। তবে এই সৌন্দর্যের আড়ালে ঢুকে পড়েছে এক বিপজ্জনক আগাছা— বিষাক্ত পার্থেনিয়াম, যা এখন দেশের বিভিন্ন ফুলের দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, পার্থেনিয়ামের সংস্পর্শে মানুষের এলার্জি, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট এবং ত্বকের মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। গবাদিপশুর ক্ষেত্রে এটি মৃত্যুঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর প্রধান দুই পাইকারি ফুল মার্কেট— শাহবাগ ও আগারগাঁও— পরিদর্শন করলে দেখা গেছে গোলাপ, গাঁদা, জুঁই, রজনীগন্ধা, পদ্মসহ নানা ফুলের সঙ্গে পার্থেনিয়াম সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে। এসব ফুল দিয়ে মালা, তোড়া তৈরি হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, জিপসি, গোল্ডেন স্টিক ও লিমোনিয়া ফুল সাধারণত সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু দাম বেশি। তাই বিক্রেতারা সস্তা ও সহজলভ্য পার্থেনিয়াম ব্যবহার করছেন, যা দেখতে জিপসির মতো। আকৃতিতে ঝোপালো এই উদ্ভিদকে অনেকে 'কংগ্রেস ঘাস' নামেও চেনেন।

বাংলাদেশে পার্থেনিয়াম নিয়ে কম গবেষণা হলেও, ইথিওপিয়ায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ কৃষক পার্থেনিয়ামের সংস্পর্শে এলার্জি সমস্যায় পড়েছেন, ৬২ শতাংশ কৃষক কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ অ্যাজমা-সদৃশ উপসর্গ ভুগেছেন। এছাড়া ২২ শতাংশ কৃষক শ্বাসের মাধ্যমে পরাগরেণু নেওয়ার পর পেটে ব্যথা অনুভব করেছেন।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ইলিয়াছ হোসেন ২০০৮ সাল থেকে পার্থেনিয়াম নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, 'গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের দেহে পার্থেনিয়ামের সংস্পর্শে প্রথমে চুলকানি ও ত্বকের সমস্যা হয়। ধীরে ধীরে এটি একজিমার রূপ নিতে পারে। শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস ও অ্যাজমা পর্যন্ত হতে পারে।'

সাজসজ্জার ফুল হিসেবে পার্থেনিয়ামের ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, 'অ্যালার্জি আজকাল সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে এবং মানুষ প্রায়ই জানে না আসল কারণ কী। তাই ব্যাপক গবেষণা দরকার। ফুল হিসেবে পার্থেনিয়াম ব্যবহার উদ্বেগজনক। সরকারের উচিত পর্যবেক্ষণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।'

যেভাবে ফুলের বাজারে প্রবেশ করল পার্থেনিয়াম

শাহবাগের বাজার থেকে সাবিকুন্নাহার তন্বী গোলাপ, গাঁদা ও জুঁই ফুল দিয়ে বানানো একটি তোড়া ও ফুলের হেডপিস কিনেছিলেন। পরে দেখা যায় তাতে ছিল পার্থেনিয়াম, যা বিক্রেতারা জিপসি বলে চালিয়েছিলেন। 

তিনি বলেন, 'আমি সবসময় এটাকে জিপসি ভাবতাম। এটা পার্থেনিয়াম হলে ভয়াবহ। সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবে কোনটা আসল জিপসি? এটা মানুষের সাথে প্রতারণা। '

ফুল বিক্রেতারা জানিয়েছেন, সাজসজ্জার ফুল মূলত আমদানি করা হয় এবং কর-শুল্কসহ প্রতি কেজিতে খরচ ১,০০০–১৫,০০০ টাকা। এক মুঠো জিপসির দাম ৪০০–৫০০ টাকা, পার্থেনিয়াম মাত্র ১০–২০ টাকা। দামের এই বড় পার্থক্য কাজে লাগিয়ে তোড়া ও মালায় সস্তা পার্থেনিয়াম ব্যবহার করা হচ্ছে।

শাহবাগের ফুল বিক্রেতা মো. মাহবুব হোসেন বলেন, 'শুনেছি এটা ক্ষতিকর, ত্বকে লাগলে চুলকায়। কিন্তু জিপসির দাম বেশি হওয়ায় মানুষের চাহিদা থাকে, তাই আমরা বিক্রি করি।'

শনিবার ভোরে রাজধানীর শাহবাগে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারি মার্কেটের সামনে মূল সড়কের ওপর অন্যান্য ফুলের মতো কয়েকজন বিক্রেতা পার্থেনিয়াম নিয়ে বসেছেন। তাদেরই একজন সিয়া রাম জানিয়েছেন, তিনি টঙ্গী রেললাইনের পাশ থেকে পার্থেনিয়াম কেটে নিয়ে আসেন এবং বড় একটি মুঠো ১০০ টাকায় বিক্রি করেন। তিনি বলেন, 'মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রতিদিন ৮০০-১০০০ টাকার পার্থেনিয়াম বিক্রি করি। মানুষে বলে এটা নাকি ক্ষতিকর, কিন্তু আমার তো কিছু হচ্ছে না।'

পার্থেনিয়ামের ভয়াবহতার কারণে জুন থেকে এটা বিক্রি নিষিদ্ধ করে আগারগাঁও পাইকারি ফুল মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি। তবে, কিছুদিন কড়াকড়ি থাকার পর আবারও বাজারে পার্থেনিয়াম বিক্রি শুরু হয়েছে— রাস্তার পাশে দোকানগুলোতে এখন অবাধে বিক্রি হচ্ছে।

সংগঠনটির সভাপতি ও বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন বলেন, 'আমাদের মূল মার্কেটে পার্থেনিয়াম বিক্রি নিষিদ্ধ এবং সদস্যরা বিক্রি করে না। আগে অনেকেই জানতেন না এটি ক্ষতিকর, তাই বিক্রি করতেন। তবে মার্কেটের বাইরে দোকানগুলো এখনো বিক্রি করে— মূলত জিপসির মতো দেখতে এবং সস্তায় পাওয়া যায় বলে।'

কীভাবে এটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ল?

'ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অফ পাররাথেনিয়াম উইড: আ রিস্ক অ্যান্ড থ্রেট টু ফুড সিকিউরিটি আন্ডার চেঞ্জিং ক্লাইমেট ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মেক্সিকো থেকে আসা ক্ষতিকর প্রজাতি 'পার্থেনিয়াম হাইস্টেরোফোরাস' দ্রুত বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এটি প্রথম ২০০৮ সালে যশোরে শনাক্ত হয়। এখন এটি ৪৫টিরও বেশি জেলায় ছড়িয়ে গেছে; সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর ও ময়মনসিংহে। এটি সড়কপথ, পরিত্যক্ত জমি ও ফসলের মাঠে বৃদ্ধি পায় এবং কমপক্ষে ২৫টি ফসলকে প্রভাবিত করে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, পার্থেনিয়ামের বিষাক্ত উপাদান বীজের অঙ্কুরোদগম, পরাগায়ন ও ফসলের ফলন কমিয়ে দেয়। এছাড়া, গবাদিপশু ও মানুষের জন্য ত্বক ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কারণ হয়। এই আগাছার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ভারতের সীমান্তের কাছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্লাইফোসেটসহ অ্যাট্রাজিন বা টেম্বোট্রিয়নের মতো হার্বিসাইড এবং এদের শংকরগুলো নতুন উদ্ভিদের ৬৯–৭৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে পরবর্তীতে এর কার্যকারিতা কমে যায় এবং পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

গবেষণা দলের প্রধান ড. ইলিয়াছ হোসেন জানান, ভারত থেকে পণ্যবাহী গাড়ির চাকায় করে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, 'একটি গাছ ৬০,০০০–১,০০,০০০ বীজ উৎপন্ন করে, যা বাতাসে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। ফসলি জমিতে এটির আক্রমণে ফলন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।' শুরুতে এটি সীমান্ত এলাকাতে থাকলেও এখন সবখানে ছড়িয়ে গেছে।'

গবেষকরা জানিয়েছেন, পার্থেনিয়ামকে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশে জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন আগাছা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তারা বলেছেন, বাংলাদেশকেও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এবং কৃষকদের এই উদ্ভিদের বাড়তে থাকা হুমকি নিয়ে সচেতন হতে হবে।

সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচারাল বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল (সিএবিআই)-এর প্রকল্প বাস্তবায়ন ও গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক আব্দুল রহমান জানিয়েছেন, পার্থেনিয়ামের বিস্তার রোধে স্বল্পকালীন এবং দীর্ঘকালীন উভয় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তিনি বলেন,'স্বল্পকালীনভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, হাতে তুলে নির্মূল এবং জৈব নিয়ন্ত্রণ এটির বিস্তার রোধে সাহায্য করতে পারে। দীর্ঘকালীন ব্যবস্থার জন্য রাসায়নিক, জৈব ও চাষাবাদ পদ্ধতিকে মিলিয়ে শক্তিশালী নীতিমালার সঙ্গে সমন্বিত পরিচালনা অত্যন্ত প্রয়োজন।'

তিনি জানান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সফলভাবে বায়োকন্ট্রোল প্রোগ্রাম চালিয়েছে, যা বাংলাদেশও গ্রহণ করতে পারে। তিনি বলেন, 'কৃষক, স্থানীয় সম্প্রদায় ও মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ— প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এর বিস্তার রোধে।'

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জহির উদ্দিন মো. বাবর বলেন, '২০২৩ সাল থেকে ফুলের তোড়া বা মালায় পার্থেনিয়াম ব্যাপক হারে ব্যবহার শুরু হয়। পরে এর ভয়াবহতা জানতে পেরে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এটা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ক্যাম্পেইন চালানো হয়। আমাদের যারা সদস্য রয়েছেন তারা আর পার্থেনিয়াম ব্যবহার করেন না। কিন্তু যারা আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার না, তাদেরকে আমরা কন্ট্রোল করতে পারি না। এক্ষেত্রে জনসচেতনতার পাশাপাশি সরকারিভাবে মনিটরিং করতে হবে।'

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফুল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফারজানা নাসরীন খান বলেন, 'আমরা বিভিন্ন ট্রেইনিংয়ে পার্থেনিয়ামের বিষয়ে সচেতন করি। এক্ষেত্রে পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক হারে ক্যাম্পেইন চালানো উচিত। মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসলে কেউ তখন বিক্রি করতে পারবে না।'

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status