কেউ ৩৫ কেউ ৩৪ বছর বেতন পান না, পড়াচ্ছেন ‘শিক্ষার্থীদের মায়ায়’
নতুন সময় প্রতিনিধি
|
![]() কেউ ৩৫ কেউ ৩৪ বছর বেতন পান না, পড়াচ্ছেন ‘শিক্ষার্থীদের মায়ায়’ এ দৃশ্য দিনাজপুর শহরের গুঞ্জাবাড়ি এলাকায় বধির ইনস্টিটিউটের। পাঠদান করা ওই শিক্ষকের নাম রাবেয়া খাতুন (৬৯)। দীর্ঘ ৩৫ বছর এখানে শিক্ষক কাম হোস্টেল সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভোর থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত শিক্ষার্থীদের খাওয়া–দাওয়া, গোসল, পড়ালেখা, খেলাধুলা, ঘুম—সবকিছুই দেখভাল করেন রাবেয়া। কিন্তু এ কাজে সরকারি কোনো বেতন পান না তিনি। স্থানীয় মানুষের অনুদানের টাকা থেকে প্রতি মাসে ভাতা পান ৬০০ টাকা। তাতে কোনো আক্ষেপ নেই রাবেয়ার। তিনি বলেন, ‘আবাসিকে ছেলে–মেয়েসহ ২৪ জন শিক্ষার্থী আছে। ওরা কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। ওদের রেখে কই যাব? মায়ায় আটকে আছি ৩৫টা বছর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওদের পাশে থাকতে চাই।’ ব্যক্তিজীবনে তিন ছেলের মা রাবেয়া খাতুন। এর মধ্যে দুজন বাক্প্রতিবন্ধী। একজন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এখন খুদে শিক্ষার্থীদের আঁকা শেখান। অপরজন অষ্টম শ্রেণি পাস। এখন কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। রাবেয়ার স্বামী মারা গেছেন ২০১৮ সালে। রাবেয়া বলেন, ‘খুব ইচ্ছা ছিল ছেলেরা পড়ালেখা শিখবে। কিন্তু বধির হওয়ার কারণে বেশি দূর যেতে পারেনি। নিজের দুই সন্তানের অবস্থা দেখে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মনের অবস্থা আমি বুঝি, বলতে না পারা কথাগুলোও বুঝি।’ যেভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বধির ইনস্টিটিউট লালমনিরহাটের বাসিন্দা বদিউল আলম। তাঁর এক বাক্প্রতিবন্ধী মেয়েকে ঢাকা বিজয়নগরে বধির ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে আবাসিক সুবিধা না থাকায় মেয়েকে ভর্তি করাননি। সেদিন স্কুল কর্তৃপক্ষ বদিউলকে নিজ এলাকায় বধির স্কুলের কার্যক্রম শুরু করার পরামর্শ দেয়। তারা বদিউলকে সহযোগিতার আশ্বাসও দেয়। সেটি ১৯৮৯ সালের কথা। ঢাকা থেকে ফিরে এসে বদিউল দিনাজপুরের গুঞ্জাবাড়ি এলাকায় তাঁর এক আত্মীয়কে বিষয়টি জানান। পরে দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী নিয়ে গুঞ্জাবাড়ি এলাকায় জুবিলী স্কুলের একটি কক্ষে নিজেই বধিরদের পাঠদান শুরু করেন। এরপর এগিয়ে আসেন দিনাজপুর পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম, স্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল হোসেন পাটোয়ারীসহ আরও কয়েকজন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্থানীয় পর্যায়ে অর্থ সংগ্রহ করে ১৯৯০ সালে জুবিলী স্কুলের দেওয়া ৪ শতাংশ জমিতে দুই কক্ষের একটি টিনশেড ভবন নির্মাণ করেন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী বেড়ে হয় ১৫ জন। ১৯৯২ সালে বদিউল আলম ঢাকায় চলে গেলে প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেন গণমাধ্যমকর্মী আজাহারুল আজাদ। তিনি স্থানীয় পর্যায়ে অর্থ সংগ্রহ করে দুই কক্ষের একটি একতলা ভবন নির্মাণ করেন। ২০০০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদার। এর মধ্যে জুবিলী স্কুল কর্তৃপক্ষ আরও ৩৬ শতাংশ জমি দান করে বধির ইনস্টিটিউটকে। ২০০৫ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পাঁচতলাবিশিষ্ট একটি ভবন নির্মান করা হয়। পরের বছর ১০ অক্টোবর সেটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আজাহারুল আজাদ বলেন, দারুণভাবে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে অভিভাবকেরা সন্তানকে এখানে ভর্তি করিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য স্কুল ভ্যান সার্ভিসও চালু করা হয়েছিল। পড়ালেখার পাশাপাশি কম্পিউটার শিক্ষা ও সেলাই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় শিক্ষকদের বেতন না পাওয়া, বধিরদের পড়ানোর জন্য দক্ষ শিক্ষক না থাকা, সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। দিনাজপুর বধির ইনস্টিটিউট উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২০। তার মধ্যে ২৪ ছেলে-মেয়ে বিদ্যালয়ে আবাসিকে থেকে পড়ালেখা করছে। শিক্ষক সাতজন, কর্মচারী আছেন পাঁচজন। তবে শিক্ষকদের বেতন না হওয়া, শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নে বরাদ্দ না থাকা, সর্বোপরি ইশারা ভাষা শিক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি না থাকায় থুবড়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। এর মধ্যে বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করেছে এক-দ্বিতীয়াংশ শিশু। বেহাল দশা বধির ইনস্টিটিউটটি ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে উপস্থিত ২৩ শিক্ষার্থীকে দুটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন শিক্ষক রাবেয়া খাতুন ও গুলশান আরা। শিক্ষক ভাঙাচোরা ব্ল্যাকবোর্ড লিখে ইশারায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা উত্তর দিচ্ছে ইশারায়। পাঁচতলা ভবনের কয়েকটি কক্ষ বাদ দিয়ে প্রায় প্রতিটি কক্ষই জরাজীর্ণ অবস্থায়। অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করছে শিশুরা। তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলার অধিকাংশ কক্ষের দরজা ভাঙা। দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে ১০টি কম্পিউটার। ধুলোবালুর আস্তর পড়েছে সেখানে রাখা বইয়ের আলমারিতে। অপর একটি কক্ষে সেলাই মেশিনসহ কারিগরি যন্ত্রপাতিও পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। একতলা ভবনের বারান্দায় পরিত্যক্ত স্কুল ভ্যানগুলো। নিচতলায় ডাইনিং রুমটিও স্যাঁতসেঁতে–অপরিচ্ছন্ন। আগে স্থানীয় একজন চিকিৎসক এসে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিলেও বর্তমানে সেটি বন্ধ। কেউ অসুস্থ হলে রাবেয়া খাতুন নিয়ে যান স্থানীয় পল্লিচিকিৎসকের কাছে। প্রতিষ্ঠানটির সাত শিক্ষকের কেউ ৩৫ বছর ধরে, কেউ ৩৪ বছর ধরে আছেন। কারও শিক্ষকতার বয়স এক যুগের কম নয়। বেতন না পেলেও বধির শিক্ষার্থীদের ছেড়ে যেতে পারছেন না তাঁরা। পড়ে আছেন শিক্ষার্থীদের মায়ায়। বধির ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক নাজনীন আক্তার বলেন, ‘১৮ বছর ধরে চাকরি করছি। বেতন না পেলেও নিয়মিত সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত স্কুল চালাই। বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে যেতে পারি না। এক দিন স্কুলে না এলে ভালো লাগে না।’ প্রধান শিক্ষক জানান, বিদ্যালয়ে শুরুতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রম ছিল। ২০১৪ সাল থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়। তিনি আরও জানান, বধিরদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকায় অষ্টম শ্রেণি পাসের পর সাধারণ স্কুলে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা খুব কম। অভিভাবকদের অসচেতনতায় অনেকে পড়ালেখা ছেড়ে কাজে যোগ দেয়। তবে এখান থেকে পড়ালেখা করে ব্যাংকে চাকরি করছেন, ঢাকায় পোশাক কারাখানায় চাকরি করছেন—এমন অনেকেই আছে। মাঝেমধ্যে স্কুলে আসে তারা। তাদের সফলতা দেখে ভীষণ আনন্দ লাগে তাঁর। ঝরে পড়ার হার বেশি, উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের বাসিন্দা রতন কুমার। ২০১৩ সালে বাক্প্রতিবন্ধী মেয়ে তনুশ্রী বর্মণকে দিনাজপুর বধির ইনস্টিটিউটে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করেন। অষ্টম শ্রেণি পাসের পর সেখানেই আবাসিকে রেখে পাশের জুবিলী স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করেন। ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করেন তনুশ্রী। পরে ২০২২ সালে পীরগঞ্জ কারিগরি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আর পড়ালেখা করেননি তিনি। বর্তমানে বাড়িতেই সেলাইয়ের কাজ করেন। মুঠোফোনে রতন কুমার বলেন, উপযুক্ত পরিবেশ একটা বড় সমস্যা। তাঁর আগ্রহের কারণে মেয়ে তনুশ্রী উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এগিয়েছেন। বিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের আর কোনো যোগাযোগ থাকে না। অন্তত সাতজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয় ছাড়ার পর আর কোথাও পড়ালেখা করাতে পারেননি তাঁদের সন্তানদের। যা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জেলা সমাজসেবা অফিস সূত্র জানায়, জেলায় মোট ১২ ক্যাটাগরিতে প্রতিবন্ধী আছে ৮৮ হাজার ৬৫৩ জন। এর মধ্যে বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী আছে ৯ হাজার ৮২৬ জন। তার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৮। বাক্প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার বিষয়ে জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, বধির ইনস্টিটিউট, ইশারা ভাষা শিক্ষার প্রতি সরকারের বিশেষ নজরদারি দরকার। ইশারা ভাষায় দক্ষ শিক্ষক না থাকলে শিক্ষার্থীরা যেমন তাদের ভাব প্রকাশে সমস্যায় পড়ে, তেমনি শিক্ষকেরাও তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হন। ফলে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একটা সময় পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে উঠছে। স্কুলে দক্ষ শিক্ষক ও উপযুক্ত পরিবেশের সুযোগ পেলে তারা সফলতা পাবে। বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষায় তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব। এ বিষয়ে দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এস এম হাবিবুল হাসান বলেন, কিছুদিন আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কমিটির সদস্যদের নিয়ে কাজ করছেন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানে অনুদানের কিছু টাকা ব্যাংকে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষকদের একটা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। আর আবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রতিজনের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মাসিক দুই হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |