ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টায় হতে পারে যেসব শাস্তি
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টায় হতে পারে যেসব শাস্তি সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনা নতুন করে আলোড়ন তুলেছে। গত বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) দিনগত রাতে মুরাদনগর উপজেলার একটি গ্রামে বসতঘরের দরজা ভেঙে ওই নারীকে (২৫) ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় ফজর আলী নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীকে বিবস্ত্র করে মারধরের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ নিয়ে সারাদেশে ওঠে সমালোচনার ঝড়। এরই মধ্যে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। উভয় মামলায় ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে গত মার্চে মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আছিয়া নামে আট বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর প্রতিবাদে তখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। যদি কোনো ব্যক্তির ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কর্মকাণ্ডের কারণে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় তবে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন ধর্ষণসহ যে কোনো ধরনের নারী নির্যাতনের লক্ষ্যে ২০০০ সালে পাস হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। এ আইনে ধর্ষণের বিচার করা হয়। ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার মামলা প্রমাণিত হলে এ আইনে বিভিন্ন রকম শাস্তির বিধান রয়েছে। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা ও গণধর্ষণের শাস্তি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ নম্বর ধারায় ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ইত্যাদি অপরাধের শাস্তির কথা বলা আছে। ৯(১) ধারা অনুযায়ী যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিয়ে ছাড়া ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছরের কম বয়সী কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়াই যৌনসঙ্গম করেন তবে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে। ৯ (২) ধারায় শিশু ধর্ষণের শাস্তির বিধান বর্ণিত হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তির ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কর্মকাণ্ডের কারণে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় তবে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ৯ (৩) নম্বর ধারায় গণধর্ষণের শাস্তির বিধান বর্ণিত হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে- যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোনো নারী আসামি ধর্ষণের শিকার হলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি বিধানও রয়েছে আইনে অর্থাৎ, উল্লিখিত আইনগুলো থেকে এ ধারণা স্পষ্ট হয় যে, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর বা ধর্ষণের ফলে হত্যা কিংবা গণধর্ষণ ইত্যাদির কারণে একজন আসামি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন৷ অন্যদিকে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে আসামি খালাস পেতে পারেন। ধর্ষণের পর হত্যাচেষ্টা ও ধর্ষণচেষ্টার সাজা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৪) ধারায় ধর্ষণের পর হত্যাচেষ্টা এবং ধর্ষণচেষ্টার সাজার বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধারাটির ৯(৪) এর ‘ক’ অংশে বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। অর্থাৎ ধর্ষণের পর ভুক্তভোগীকে হত্যার চেষ্টা করলেও আসামিকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ ধারার (খ) অংশে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন। অর্থাৎ, ধর্ষণ সংঘটিত হয়নি, কিন্তু আসামি শারীরিকভাবে ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন এমনটি প্রমাণিত হলে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সাজা পেতে পারেন। পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণের সাজা এছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোনো নারী আসামি ধর্ষণের শিকার হলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি বিধানও রয়েছে এ আইনে। অনেক কারণে দোষীদের সাজা নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে দিয়েও আমরা দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি এবং নিয়মিত ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার রায় হচ্ছে, সাজা হচ্ছে।- পিপি আবুল কালাম আজাদ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৫) ধারায় বলা হয়েছে- যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন এরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা ধর্ষণের শিকার নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তিনি বা তারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এখানে উল্লেখ্য, কোনো পুলিশ সদস্য নারী আসামিকে ধর্ষণ করলে তার বিচার স্বাভাবিকভাবেই ৯(১) ধারায় অনুষ্ঠিত হবে। এতে যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে কোনো পুলিশ সদস্য তার নিজ হেফাজতে থাকা নারী আসামিকে ধর্ষণ করেননি, তবে অন্য কোনো ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে থাকা নারীকে ধর্ষণ করেছেন, এমনটি প্রমাণিত হলে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য ওই পুলিশ সদস্যের সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। পাশাপাশি করা হতে পারে অর্থদণ্ডও। নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার সাজা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(ক) ধারায় সম্ভ্রমহানি হওয়ার মতো প্রত্যক্ষ কারণ সংঘটনের জন্য সাজার বিধান বর্ণিত হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে- কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারী আত্মহত্যা করলে ওই ব্যক্তি ওই নারীকে অনুরূপ কার্য দ্বারা আত্মহত্যা করিতে প্ররোচিত করার অপরাধে অপরাধী হবেন এবং ওই অপরাধের জন্য তিনি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন। অর্থাৎ, যৌন হয়রানির ফলে কোনো নারী মনঃক্ষুণ্ন হয়ে আত্মহত্যা করলে হয়রানি করা ব্যক্তির সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। নারী ও শিশু অপহরণের শাস্তি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৫-এ উল্লিখিত কোনো অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অন্যূন ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। অর্থাৎ, কোনো অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করা হলে আসামি ১৪ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ এছাড়া ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে কোনো নারী বা শিশুকে আটক করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। মিথ্যা মামলার শাস্তি আইনটির ১৭(১) ধারায় এ আইনে মিথ্যা মামলা, অভিযোগ দায়ের ইত্যাদির শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন ওই ব্যক্তি অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। অর্থাৎ, যদি কেউ ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যে কোনো ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করেন এবং নেপথ্যে থেকে কেউ দায়ের করতে প্ররোচনা দেন, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি ২০০০ সালে প্রণীত হয়। পরে ২০০৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। ধর্ষণরোধে এ আইনটির প্রয়োগ সম্পর্কে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ ইত্যাদির বিচারের জন্য এ আইনটি যথেষ্ট। তবে অনেক সময়ই বিভিন্ন মামলা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া অনেক মামলায় বাদীপক্ষ ও আসামিপক্ষ আপস করে। এসবের কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আবার অনেক সময় মামলার চার্জশিটে আসামির বর্তমান ঠিকানা লেখা হয়, কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা লেখা হয় না। ফলে সাক্ষী বাসা পরিবর্তন করে ফেললে সমন পৌঁছায় না। এমন অনেক কারণে দোষীদের সাজা নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে দিয়েও আমরা দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি এবং নিয়মিত ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার রায় হচ্ছে, সাজা হচ্ছে।’ |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |