ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
শনিবার ৮ নভেম্বর ২০২৫ ২২ কার্তিক ১৪৩২
মহাশূন্য থেকে ছুটে আসা এই অতিকায় পাথরখণ্ডটি এখন জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Saturday, 18 October, 2025, 12:07 PM

মহাশূন্য থেকে ছুটে আসা এই অতিকায় পাথরখণ্ডটি এখন জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র

মহাশূন্য থেকে ছুটে আসা এই অতিকায় পাথরখণ্ডটি এখন জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র

আমাদের গাড়ি যত কাছে যাচ্ছে, তত ছায়ার মতো অতিকায় পাহাড়টি চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে। পাদদেশে নেমে দেখি নানা গাছপালা, ঘাসের প্রান্তর আর ছোট ছোট জলাশয়। চারদিক শান্ত ও নির্জন। একটা জায়গায় বেশ ঘন গাছপালা। সেখানে দুটো কৃশ হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি গ্রাহ্যই করল না। মানুষ দেখতে দেখতে তারা অভ্যস্ত নিশ্চয়ই।

স্টোন মাউন্টেইনের কথা আগে শুনেছিলাম। তখন থেকে মনে হয়েছিল পাথরের পর্বত মানে রুক্ষ, বৈচিত্র্যহীন ও বিষণ্ন একটা কিছু হবে। কিন্তু পাথরের বুকও যে এতটা লাবণ্য ধরে রাখে, আগে বুঝিনি। ফোবানা উৎসব যোগ দিতে আগস্টের শেষ সপ্তাহে আটলান্টা গিয়েছিলাম। কলেজ জীবনের সহপাঠী রাফি সৈয়দ আর সারোয়ার কামালের অতি আগ্রহ আমাকে চুম্বকের মতো স্টোন মাউন্টেইনে টেনে নিয়ে গেল। 

সারোয়ার বলল, পর্বতটাতে ওঠার আগে অনেকেই ভাবে সেখানে তারা অনেক পাথর দেখতে পাবে। আসলে তা না। এই পাহাড়টির পুরোটাই একটা বিশাল গ্রানাইট শিলা। অর্থাৎ একটা পাথর দিয়ে গঠিত একটা পাহাড়। পৃথিবীর বৃহত্তম একক গ্রানাইট গঠনগুলোর একটি স্টোন মাউন্টেইন।

প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে মহাশূন্য থেকে ছুটে এসে এই অতিকায় পাথরখণ্ডটি পৃথিবীর বুকে আসন পেতেছিল। ভাবতে অবাক লাগল যে পাথরের ওপর আমি দাঁড়িয়ে আছি, সেটি মানবসভ্যতার বহু আগেই জন্ম নিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো প্রকৃতি আর ইতিহাস যেন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল ধূসর পাহাড়টা দূর থেকে কঠিন আর নীরব মনে হয়েছিল, অথচ কাছে এসে মনে হলো এটি জীবন্ত। সত্যিই স্টোন মাউন্টেইন পার্ক শুধু পাহাড় নয়, এটা এক বিশাল বিনোদন ও ঐতিহাসিক কেন্দ্র। 

পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে বানানো হয়েছে জেফারসন ডেভিস, রবার্ট ই. লি আর স্টোনওয়াল জ্যাকসনের বিশাল ভাস্কর্য। এই তিনজনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ আর দাসপ্রথার ইতিহাস। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালে দাসপ্রথার পক্ষ-বিপক্ষে দুই ভাগ হয়ে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয় আমেরিকা। উত্তরের রাজ্যগুলো চেয়েছিল দাসপ্রথা বন্ধ হোক। 

আর দক্ষিণের রাজ্যগুলো চেয়েছিল দাসপ্রথা থাকুক। এই নিয়ে গৃহযুদ্ধ। পরে দক্ষিণের ১১টি রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে গঠন করে কনফেডারেট স্টেট অব আমেরিকা (কনফেডারেসি)। দাসপ্রথা চালু রাখার পক্ষের রাজ্যগুলোর নেতা ছিলেন এই তিনজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে ওরা জিততে পারেনি, জিতেছিল উত্তর। ফলে বিলুপ্ত হয় দাসপ্রথা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার গৃহযুদ্ধের খলনায়কদের নাম ওরা ভোলেনি, পাথরের গায়ে তাদের ভাস্কর্য খোদিত করা হয়েছে।

কীভাবে সপ্রাণ হয়ে ওঠে পাথর
দিনের আলোয় স্টোন মাউন্টেইন প্রকৃতির আশ্রয়-হ্রদ, সবুজ মাঠ, কেব্‌ল কারের রোমাঞ্চ। আর সন্ধ্যা নামলে পাহাড়ের গায়ে জ্বলে ওঠে রঙিন রশ্মি। লেজার শোর মাধ্যমে দেখানো হয় অতীতের ইতিহাস। রাতে আলো, শব্দ আর ইতিহাস মিলেমিশে পর্বতে তৈরি হয় অদ্ভুত মায়াময় এক পরিবেশ। পাহাড়ের নিচে আরও রয়েছে মেমোরিয়াল মিলনায়তন। সেখানে দেয়ালে টাঙানো ছবি, যুদ্ধের স্মারক আর পুরোনো নথিতে প্রতিধ্বনিত হয় আমেরিকার অতীত। মিলনায়তনে মাঝেমধ্যে আয়োজিত হয় সংগীতানুষ্ঠান বা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী।

নিচে এসব দেখতে দেখতে ওপরে ওঠার জন্য মনটা আকুল হয়ে ওঠে। ওপরে ওঠার দুটো উপায়—হন্টন অথবা কেব্‌ল কার। আমরা কেব্‌ল কারই বেছে নিলাম। কেব্‌ল কারের কাচের জানালা দিয়ে বাইরের সবকিছু দেখা যায়। চোখের সামনে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে বাইরের জগৎ। পৃথিবীটা ধীরগতিতে কোথাও যেন নেমে যাচ্ছে। গাছগুলো বনসাইয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। চোখের সামনে ক্রমেই নিজেকে মেলে ধরল বিশাল আটলান্টা। ভয় আর রোমাঞ্চে আমার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে আমার স্ত্রী জ্যোৎস্না। এসবে অভ্যস্ত সারোয়ার হাসছে।

পর্বতের ওপরে উঠে প্রথমে মনে হলো দূর কোনো অজানা গ্রহে এসে পড়েছি। খাঁজকাটা, অমসৃণ সমতল। কিন্তু পরক্ষণেই পাথরের ভেতর থেকে ডালপালা ছড়ানো ছোট ছোট উদ্ভিদ আর সেসবের ডালপালায় ফুটে থাকা রং ছড়ানো ফুলের সৌরভে ভুল ভাঙল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৬৮৬ ফুট ওপরে প্রকৃতি তার রূপ আমাদের মোহিত করে।

সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে নেমে এসেছে, নরম হয়ে এসেছে আলো, ঠান্ডা হয়ে আসছে বাতাস। চারপাশে ছোট ছোট বুনো ফুল ফুটে আছে, পাথরের ফাঁকে তারা রং ছড়িয়েছে—হলুদ, বেগুনি, সাদা। দু-একটা বড় গাছও দেখলাম। পাথরের কঠিন শরীরে গাছগুলো কীভাবে শিকড় ছড়াল, তা–ও এক বিস্ময়। পাথরের গায়ে জীবনের এমন রঙিন বিস্তার অনেক পর্যটককেই ভাবনার অতলে নিয়ে যায়। ওপরে উঠে বুঝলাম কীভাবে সপ্রাণ হয়ে ওঠে পাথর। পাথরের এই বিশালতা আমাকে আকুল করে দিয়েছে। মনে হলো বস্তুও মাঝেমধ্যে খুব আপন হয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরে। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই মনোলিথটি নিঃশব্দে আমাদের এই গ্রহটাকে যেন পাহারা দিচ্ছে। আমরা তিনজন ফুলের কাছাকাছি একটি জায়গায় বসলাম। নিচ থেকে সারোয়ার আমাদের জন্য নানা রকম মজাদার খাবার এনেছে। সেসব খেতে খেতে সে বলল, ‘একসময় এই পাহাড়ের পাশে মানুষ আসত না। বর্ণবাদী গুপ্ত সংগঠন “কু ক্লাক্স ক্ল্যান” কালো মানুষদের হত্যা করে এখানে ফেলে যেত।’

কথাগুলো শুনে গা শিউরে উঠল। সূর্য তখন ডুবছে, লাল আলোর আঁচে পাহাড়ের গা জ্বলজ্বল করছে। মনে হলো, ইতিহাসের রক্তরং এখনো এই পাথরে লেগে আছে। সেই মুহূর্তে মনে পড়ল মানবসভ্যতার নিষ্ঠুরতার ইতিহাস কত রূপে, কত সময়ে মানুষ মানুষকে আঘাত করেছে! স্টোন মাউন্টেইনের শীতল পাথর যেন সেই দুঃখের নীরব সাক্ষী। এত আঘাত, এত কষ্ট, তবুও এগিয়ে চলেছে জীবন।

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status