জীবনে চলার পথে বিভিন্ন কারণে বিষণ্ণতা ঘিরে ধরতে পারে, থমকে যেতে পারে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। হতাশার এই সময়ে সঠিক দিকনির্দেশনা সাহায্য করতে পারে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। নিয়মিত আয়োজনে আপনার মনের কথাগুলো শুনে পরামর্শ দেবেন মনোরোগ চিকিৎসক। পরিচয় গোপন রেখে যেকোনো ধরনের মানসিক টানাপোড়েনের বিষয় আমাদের জানাতে পারেন এখানে
প্রশ্ন: আমার বয়স ২৪ বছর। বাবা-মায়ের উপর অনেক অভিমান আমার। আমি বলেছিলাম পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাই, আরও কিছুটা সময় চায়। কিন্তু তারা তাড়াহুড়ো করে এবং আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে দিয়ে দেয় আমার। বিয়ের পর জানতে পারি স্বামীর অন্যত্র সম্পর্ক, পরে ডিভোর্স দিয়ে দিই। এই বিষয়টি নিয়ে বাবা-মায়ের উপর অনেক অভিমান কাজ করে। আমি কোনও অপরাধ না করেও সমাজের চোখে ডিভোর্সি হয়ে গেছি। বাবা-মাও অনুতপ্ত, আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু আমি কোনোভাবেই তাদের ক্ষমা করতে পারছি না। দুই বছর হয় তাদের সাথে ঠিক মতো কথাও বলি না। আমারও ভীষণ কষ্ট হয়, কিন্তু স্বাভাবিক আচরণ আর করতে পারি না।
উত্তর: নিজের অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিন: আপনার রাগ, কষ্ট, অভিমান– এই সবগুলো অনুভূতিই স্বাভাবিক। এগুলোকে চেপে না রেখে প্রকাশ করার স্বাস্থ্যকর উপায় খুঁজুন। সেটা হতে পারে বিশ্বস্ত কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে কথা বলা, ডায়েরি লেখা অথবা এমন কোনও কাজ করা যা আপনাকে মানসিক শান্তি দেয়। আপনি আপনার অনুভূতি আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন। এর মাধ্যমেই আপনার মস্তিষ্ক দ্রুত আপনার আবেগ-অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। কান্না পেলে কাঁদুন। কান্না দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং এটা জমে থাকা কষ্ট বের করে দিতে সাহায্য করে।
ক্ষমা করার বিষয়টি বিবেচনা করুন (নিজের স্বার্থে): ক্ষমা করা মানে এই নয় যে আপনি যা ঘটেছে তা ভুলে গেছেন বা তাদের কাজকে সমর্থন করছেন। অন্যের প্রতি রাগ ও ঘৃণা পুষে রাখলে তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে নিজেরই। ক্ষমা করা হলো নিজের ভেতরের ক্ষোভ ও যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়া; নিজেকে মানসিক চাপমুক্ত করা, তথা সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু অর্জনের লক্ষ্যে অটুট থাকা। ক্ষমা একটি প্রক্রিয়া, এটা একবারে হয়ে যায় না। ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে পারেন। হয়তো এখনই পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারবেন না, কিন্তু তাদের সাথে ন্যূনতম স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতে পারেন। বাবা-মা আপনার ভালোর জন্যই হয়তো তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদিও সেই পদ্ধতি ভুল ছিল এবং তার ফলস্বরূপ আপনাকে ভুগতে হয়েছে। তাদের অনুতাপকে আপনার মস্তিষ্ক আপনার অজান্তেই বিবেচনায় নিয়েছে।
বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগের একটি ভারসাম্যপূর্ণ পথ খুঁজুন: আপনি বলেছেন যে দুই বছর ধরে তাদের সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না, এতে আপনার নিজেরও কষ্ট হয়। সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়তো দীর্ঘমেয়াদে আপনার মানসিক শান্তির জন্য সহায়ক নাও হতে পারে। ছোট ছোট পদক্ষেপে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে পারেন। হয়তো শুরুতে অল্প সময়ের জন্য কথা বললেন, ধীরে ধীরে সেটা বাড়াতে পারেন। তাদের সাথে কথা বলার সময় আপনার অনুভূতিগুলো শান্তভাবে প্রকাশ করতে পারেন। বলতে পারেন যে তাদের সিদ্ধান্তে আপনি কতটা আঘাত পেয়েছেন এবং আপনার জীবন কতটা প্রভাবিত হয়েছে।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অতিরিক্ত ভাববেন না: এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের সমাজ এখনও বিবাহবিচ্ছেদের মতো একটি বিষয়কে সহজভাবে নিতে পারে না এবং প্রায়শই নারীদেরকেই এর জন্য দায়ী করে। মনে রাখবেন, যারা আপনাকে বিচার করছে, তারা আপনার জীবনের কষ্টকর অধ্যায়গুলো দেখেনি বা অনুভব করেনি। তাদের কথায় নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট করবেন না। যারা আপনাকে বোঝে এবং আপনার পাশে থাকে, তাদের সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত করুন।
নিজের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মনোযোগ দিন: অতীতের কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে মনোনিবেশ করুন। আপনার পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারের যে স্বপ্ন ছিল, তা পূরণের জন্য নতুন করে উদ্যমী হোন।
নিজের যত্ন নিন। শখের কাজ করুন, নতুন কিছু শিখুন, নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। আত্মনির্ভরশীলতা আপনাকে মানসিক শক্তি যোগাবে।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন: যদি মনে হয় এই মানসিক যন্ত্রণা আপনি একা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, তাহলে একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে পারেন। তারা আপনাকে আপনার অনুভূতিগুলো সঠিকভাবে বুঝতে এবং সেগুলো মোকাবিলার সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করবে। একজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বললে আপনি এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পেতে পারেন।