যাদের হাত ধরে জেনারেশন জেড
নতুন সময় ডেস্ক
|
যাদের হাত ধরে তেজোদীপ্ত বৈষম্যবিরোধী ‘জেনারেশন জেডে’র এ পৃথিবীতে আগমন, তারা কেন আজ বঞ্চিত, কেন তারা আজ নিদারুণ বৈষম্যের শিকার? বলছি দেশের অবস্টেট্রিসিয়ান ও গাইনোকলজিস্টদের কথা। অবস্টেট্রিসিয়ান ও গাইনোকলজিস্টরা এদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের সেবা দেন। কিশোরী থেকে শুরু করে রজোনিবৃত্তি (বার্ধক্য পর্যন্ত) নারীদের সেবা দেন তারা। অথচ চাকরি জীবনে-কী সরকারি, কী বেসরকারি-সর্বত্র তারা নিগৃহীত। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি এবং মূল তিনটি বিষয়ের (অবসটেট্রিকস ও গাইনোকলজি, মেডিসিন ও সার্জারি) মধ্যে কাজের চাপ কাছাকাছি। বরং অবস্টেট্রিক্যাল ইমার্জেন্সি সবকিছুকে ছাড়িয়ে। রাত নেই, দিন নেই-প্রসব বেদনার রোগী এবং প্রসবজনিত ভয়াবহ বিভিন্ন জটিলতার ব্যবস্থাপনার জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট সময়। আর এ ইমার্জেন্সি শক্ত ও দক্ষ হাতে সামলে নিচ্ছেন আমাদের অবস্টেটিসিয়ান ও গাইনোকলজিস্টরা। অথচ মেডিসিন ও সার্জারির সঙ্গে অবস/গাইনির অকল্পনীয় বৈষম্য বিরাজমান। মা ও নবজাতক স্বাস্থ্যের আগের ও বর্তমান অবস্থা : উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে মা ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। অবস্টেট্রিসিয়ানদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৯০ সালে প্রতি লাখে ৫৭৪ থেকে কমে ২০২৪ সালে ১২৩ হয়েছে। এমডিজি ৫-এ ২০১৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার যে লক্ষ্য ছিল, সারা বিশ্বে মাত্র ৯টি দেশ সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিল। আমরা গর্বিত অবস্টেট্রিসিয়ানরা বাংলাদেশকে সেখানে নিয়ে গেছেন। একইভাবে এমডিজি-৪-এর লক্ষ্যের চেয়েও দ্রুত সদ্যোজাত শিশুমৃত্যু ১৯৯৩ সালে ৫২/১০০০ থেকে ২৮/১০০০-এ উন্নীত হয়েছে। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে টারশিয়ারি হাসপাতালগুলোতে অবস্টেট্রিসিয়ানদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে। আর এমডিজি ৪ ও ৫-এর লক্ষ্যে পৌঁছানোর সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছিল। কিন্তু সে পুরস্কারের ভাগিদার তারা তো হনইনি, তাদের চাকরিতে প্রাপ্য পদোন্নতিও দেওয়া হয়নি যুগ যুগ ধরে। তারপরও তারা এসডিজির লক্ষ্যে পৌঁছাতে বদ্ধপরিকর। চিকিৎসক শুধু চিকিৎসকই নন : সারা দেশে উপজেলা, জেলা হাসপাতাল ও ৩৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মিলে ৬৩৮টি হাসপাতালে অবস ও গাইনি বিশেষজ্ঞরা সেবাদান করে আসছেন। মেডিকেল কলেজে যারা আছেন, তাদের হাসপাতাল সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো, পরীক্ষা নেওয়া এবং চিকিৎসক হওয়ার পর প্রশিক্ষণ দেওয়া-এ কাজগুলো করতে হয়। আছে পোস্টগ্র্যাজুয়েট বিভিন্ন কোর্স (এফসিপিএস, এমএস, ডিজিও), সেগুলোর পরিচালনা, পড়ানো, প্রশিক্ষণ দেওয়া, ডিজার্টেশন গাইড করা, অন্যদের গাইড করাটা পরীক্ষা করা, থিসিস গাইড করা, প্রার্থীদের থিসিস ডিফেন্স পর্যালোচনা করা এবং বিভিন্ন পোস্টগ্র্যাজুয়েট পরীক্ষা কনডাক্ট করা। প্রতিনিয়ত রক্তক্ষয়ী মরণাপন্ন ইমার্জেন্সি রোগীদের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধের সঙ্গে এতগুলো বাড়তি কাজের চাপে একেকজনের জীবন নিষ্পেষিত থাকে। এর সবকিছুই মোচন হতে পারে তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পদোন্নতির মাধ্যমে। বর্ণিত কাজগুলো অধ্যাপকদের করার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় অধ্যাপক না থাকার ফলে অধ্যাপকের কোয়ালিটিসম্পন্ন সহকারী অধ্যাপকও নন এমন বিশেষজ্ঞরাও কাজগুলো করে থাকেন। কাজেই তাদের দ্বারা সিনিয়র পদগুলোর কাজ আদায় করে নেওয়া হলেও দেওয়া হচ্ছে না পদ ও পদবি। অমানবিক এক বৈষম্যের চিত্র : সার্জারি ও মেডিসিনে ২১তম বিসিএসের চিকিৎসক অধ্যাপক হলেও গাইনিতে ১৫তম বিসিএসেরও আংশিক মাত্র অধ্যাপক হতে পেরেছেন। একইভাবে অন্যগুলোয়ও সার্জারি মেডিসিনে অনেক জুনিয়রদের পদোন্নতি হলেও বঞ্চিত রয়ে গেছেন অবস/গাইনি বিশেষজ্ঞরা। কেন এ বৈষম্য : পদোন্নতির শর্তগুরো সবার জন্য এক হওয়া (বিসিএস ব্যাচভিত্তিক) এবং সবাই একইরকম যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও কেন এ বৈষম্য, তা বোধগম্য নয়। ৬৪২ জন জেনারেল অবস/গাইনি বিশেষজ্ঞ এবং ৮৬ জন সুপারস্পেশালিস্ট (ষষ্ঠ গ্রেডপ্রাপ্ত) পদোন্নতির অপেক্ষায় আছে। ক্যানসার, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা ও ইনফার্টিলিটিতে সুপারস্পেশালিস্ট ডাবল পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করা ছেলেমেয়েরাও পদোন্নতির অভাবে এ বিশেষায়িত কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পোস্টগ্র্যাজুয়েশন যেমন ব্যাপক, তেমনি কষ্টসাধ্য। যখন সেই কষ্ট ও যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় না, তখন মানসিকভাবে হীনম্মন্যতা চলে আসে। ফলে সামনে অগ্রসর হওয়ার উদ্দীপনা নষ্ট হয়ে যায়। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি ধারাবাহিক আমৃত্যু অগ্রগামী বিষয়। তাদের এ ক্ষুণ্ন মনোবল এসডিজি অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পদোন্নতি না হওয়ায় সৃষ্ট সংকট : ৩৭টি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের জন্য পর্যাপ্ত বা প্রয়োজনীয় পদ নেই। কম হলেও সুপার স্পেশালিস্ট পোস্টসহ ৫০০-এর বেশি পোস্ট থাকা দরকার। সেখানে পদ আছে ৩০৬টি। তা-ও পূর্ণ নয়। হাস্যকর হলেও সত্য, পোস্ট পূর্ণ আছে ২৭৯টি। বাকি পোস্টগুলো শূন্য। অথচ এ শূন্য পদগুলো পূর্ণ করার যোগ্যতা নিয়ে বসে আছেন অনেকে। এ বিপুল জনসংখ্যার দেশে প্রয়োজনের তুলনায় কমসংখ্যক লোকবল নিয়ে তাদের কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বহু পোস্টগ্র্যাজুয়েট করা বিশেষজ্ঞ ১০-১৪ বছর ধরে উপজেলায় কাটাচ্ছেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় তাদের বঞ্চনা অপরিসীম। মেডিকেল কলেজের সংস্পর্শে না থাকায় তারা বঞ্চিত হয়েছেন নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা থেকেও। বর্তমানে বেশিরভাগ উপজেলায় পদোন্নতি পেয়ে ইউএইচএফপিও হয়েছেন গাইনি চিকিৎসকদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ডাক্তাররা। ফলে তাদের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে সিনিয়র গাইনোকলজিস্টদের কাজ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কাজের স্পৃহা ধরে রাখা কষ্টকর। অনেকেরই অবসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে, তারা এক বুক দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে পদ না পেয়েই অবসরে চলে গেছেন। সমাধানের উপায় : অবশ্যই পর্যাপ্ত পদ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু অপেক্ষমাণ সিনিয়র গাইনোকলজিস্টের সংখ্যা এত বেশি যে, পদ সৃষ্টির লম্বা প্রক্রিয়ায় তাদের অবসরের সময় চলে আসবে। অনেকেই দীর্ঘদিন তার প্রাপ্য জায়গায় যেতে না পেরে বঞ্চিত হবেন। তাই জেনারেল অবস/গাইনি এবং একইসঙ্গে সুপারস্পেশালাইজড বিষয়গুলো যেমন-ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিন, গাইনোকলজিক্যাল অনকোলজি, রিপ্রডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি এবং ইনফার্টিলিটি বিষয়ে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি, পদায়ন ও ইন সিটু প্রমোশন ভূতাপেক্ষভাবে প্রদান করে এ জটিলতার অবসান ঘটানো প্রয়োজন। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের জন্য অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। জরুরিভিত্তিতে মেডিসিন সার্জারির সঙ্গে সমতা রক্ষা করে (ভূতাপেক্ষভাবে) অবস/গাইনিতে জুনিয়র কনসালট্যান্ট, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদায়নের দাবি জানাচ্ছি। সুপারস্পেশালিটি বিষয়ে রিপ্রডাক্টিভ এন্ডোক্রাইনোলজি ও ইনফার্টিলিটি, গাইনোকলজিকাল অনকোলজি এবং ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিনে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি ও পদায়ন ও প্রয়োজনে ইন সিটু পদায়নের দাবি জানাচ্ছি। আশা করি, এ বৈষম্যবিরোধী নতুন সরকারের হাত ধরে এ দেশের নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে সেই স্বাস্থ্যসেবার কর্ণধার অবস্টেট্রিসিয়ান ও গাইনোকলজিস্টদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার দিক উন্মোচিত হবে। |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |