চরম বৈষম্য এবং নিগ্রহ থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরেন লাখো বাঙালি। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সব বয়সী বাঙালির লক্ষ্য স্থির করে দেয়। আর তাই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। সেই সময়কার সুসজ্জিত শক্রুপক্ষকে নিধন করতে করতে শহিদ হয়েছেন অনেকে। হানাদার বাহিনীর ক্ষমতার পাটাতন কাঁপিয়ে দেয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস আর হার না মানার দৃঢ় মনোবল। বাঁচা-মরার সেই সংগ্রামে বেঁচেও যান অনেকে। তারাই হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলাদেশের এক একজন প্রাণপুরুষ। তাদের সঙ্গে কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে লড়েছেন অসীম সাহসী নারীরাও। কেউ কেউ সম্ভ্রম হারিয়ে পেয়েছেন বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি, হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা।
স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধুর এক ডাকে যারা সব কিছু বিসর্জন দিয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করেছেন, মহান স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মাথায় তাদের জন্য বিশেষ কোটা সুবিধা চালু করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যারা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ছিলেন প্রথমত তারাই অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিলেন। সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তাদের অনেকে অঙ্গ হারিয়েছেন, হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের বাড়িঘর। এসব ঘৃণ্য কাজে হানাদারদের দোসর হয়ে কাজ করেছে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রাজাকার।
স্বাধীন বাংলায় বহুল কাঙ্খিত ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বরের প্রথম সূর্যোদয় দেখে আনন্দে আত্মহারা বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ফিরতে থাকেন নিজের বাড়ি-পরিবারের সদস্যদের কাছে। বাড়িঘরে ফিরে পরিশ্রান্ত স্বজনহারা মুক্তিযোদ্ধারা নিজের চোখে দেখতে পাকহানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের তাণ্ডব আর নির্মমতার চিহ্ন। এসব দেখে সইতে না পেরে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন কেউ কেউ
২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে চরম বৈষম্যের পাশাপাশি যুদ্ধের ধকলে পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে কোটা সুবিধা চালু করেন বঙ্গবন্ধু। সরকারি চাকরিতে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে চালু হওয়া সেই কোটা সুবিধার আওতায় বিপর্যস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৩০ শতাংশ। তবে তখন এর আওতায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা নাতি-নাতনিদের দেয়া সুবিধা অর্ন্তভুক্ত ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়কালে এবং ১৯৭৫ পরবর্তী এই কোটায় অনেকেরই চাকরি হয়েছে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে কোটা সংরক্ষণ করে দিয়েছিলেন এর প্রয়োজনীয়তা সর্বোচ্চ দুই দশকের মধ্যে শেষ হয়ে যাওবার যৌক্তিকতা ছিল। তেমন পথেই এগোচ্ছিল।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) তথ্য অনুযায়ী ১৯৮২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমতে শুরু করে। আশির দশকের শেষ দিকে এটি মাত্র এক শতাংশে নেমে আসে। বরাদ্দকৃত ২৯ শতাংশ কোটাই অপূর্ণ থেকে যায়। এজন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকে দুষছেন অনেকে। অনেকে মনে করেন, স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় ২০ বছরের মধ্যে চাকরিপ্রার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের বয়স সরকারি চাকরিতে আবেদন করার বয়সসীমা পেরিয়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। এসময় সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি জোরালো হতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয় বিপিএসসি। সেই সঙ্গে নারী কোটা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। সেই সময় প্রায় এক দশক ধরে সরকারি কর্ম কমিশন সামগ্রিক কোটা ব্যবস্থার সংস্কার ও সময়োপযোগী করার কথা বলে গেছে। তবে কোন সরকারই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি
এদিকে,বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বড় ধরনের সংস্কার আনেন শেখ হাসিনা। বলা হয়, এই কোটায় চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থী পাওয়া না গেলে অপূর্ণ কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধর বা সন্তানদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিধান চালু করা হয়।
এতে করে বাংলাদেশে স্বর্ণের হরিণখ্যাত সরকারি চাকরি পেতে মরিয়া হয়ে পড়েন অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা। এ সুযোগ বাগিয়ে নিতে অনেকে তদবির করে বনে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর তাদের সন্তানেরা অবাধে হাতিয়ে নিতে থাকেন স্বর্ণের হরিণ। এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৪ বছর পর কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদেরও বয়স ছাড়িয়ে গেছে ৭০ বছর। এই বয়সে এই দেশে বাবা হওয়ার রেকর্ড অনেকটাই বিরল। আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যারা বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তাদের সন্তানদের সিংহভাগই চাকরিপ্রার্থী হওয়ার বয়সসীমা পার করে ফেলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরকে দেয়া কোটা সুবিধার সঠিক কার্যকারিতাও গত ২৭ বছরে প্রায় ফুরিয়ে গেছে। তবে ২০১১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের দিয়ে এ কোটা পূরণের সুযোগ রেখে নতুন বিধান চালু করা হয়। এতে করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা স্পর্শ করলো তৃতীয় প্রজম্মকে। এই সুবিধা চলতে থাকলে আর দুই দশক তাও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। তখন কী নাতি-নাতনিদের সন্তানদেরকে এই সুবিধা দেয়া হবে? এমন প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছি কোটা সংস্কারের দাবিতে অনড় অবস্থানে থাকা আন্দোলনকারীদের কারো কারো মনে।
গত ৫৪ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধার আওতায় কতজন চাকরি পেয়েছেন তার সঠিত তথ্য বিপিএসসির কাছে নেই। আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি নাতনিরা এই সুবিধাভুক্ত হওয়ার পর সেই তালিকা কতটা দীর্ঘ হবে তা অনুমান করার মতো যোগ্যতা রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির নেই বললেই চলে। কেননা বিপিএসসি গত তিন দশকের বেশি সময় নিজের অন্যতম কাজ প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা রক্ষায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, এক ধরনের হীনমন্যতার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছে বিপিএসসি।