নির্বাচনের বছরে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এতদিন সাম্প্রদায়িক মন্তব্যে সরাসরি গা ভাসাতেন না তিনি। নিজেকে রাখতেন সাধু‑সন্তদের ভিড়ে, কিছুটা আড়ালে। তবে ভোট যত এগিয়ে এল, মোদি ঝেড়ে ফেললেন সব আড়াল। সাম্প্রদায়িক মন্তব্য থেকে শুরু করে কয়েক দিনব্যাপী ধ্যান–সবকিছুই করলেন তিনি। কিন্তু তাও কি শেষ রক্ষা হলো?
মোদির দল বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য এবারের নির্বাচনে সবকিছু উড়িয়ে দেওয়া জয় খুব প্রয়োজন ছিল। বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট তাই কংগ্রেসের ইন্ডিয়া জোটকে ভেঙেচুরে এগিয়ে যেতে চাইছিল। নইলে যে ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ভারতের সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থায় বিজেপি আনতে চাইছে, সেটি আনা কঠিন হয়ে যাবে। আজকের দিনটির আগ পর্যন্ত বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির একমাত্র লক্ষ্য ছিল কংগ্রেসসহ ইন্ডিয়া জোটকে স্রেফ মুছে ফেলার। এর জন্য যাবতীয় আবহ তৈরির কাজও পুরোদমে করেছে মোদির বিজেপি। কংগ্রেসের ইন্ডিয়া জোটও কিছুটা ম্রিয়মাণই ছিল বলা চলে। কিন্তু ভোট গণনা শুরুর পর পাওয়া প্রাথমিক ফলাফলে পুরো ঘটি উল্টে যাওয়ার জোগাড়!
গত ১৯ এপ্রিল শুরু হয়েছিল ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। শেষ হয়েছে ১ জুন। দেড় মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৬৪ কোটিরও বেশি ভোটার। দিল্লির মসনদ কার হবে–সেই প্রশ্নে ভোট দিয়েছেন ভারতীয় নাগরিকেরা।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতা‑ছাড়া হয়েছিল কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধী শিবির। এর পর থেকে যত দিন গেছে বিজেপি মতান্তরে নরেন্দ্র মোদি কেবলই শক্তিশালী হয়েছেন। কংগ্রেসের অনেক ঘাঁটিতেও তারা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছে। যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিই বিজেপির একমাত্র অবলম্বন, সেই ঘরানা ভারতের গভীরে প্রোথিত হওয়ার লক্ষণ ফুটে ওঠে ক্রমে। আর ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধীদের যেন বানের জলে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়। গত লোকসভা নির্বাচনে ২৮২টি আসনে জয়ী হয়েছিল বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ওই নির্বাচনের শেষ দফা ভোট গ্রহণের দুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংবাদ সম্মেলন করে মোদি আগাম জানিয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠন করার কথা! অর্থাৎ, একেবারে বলে‑কয়ে জেতা যাকে বলে। যদিও সেবার নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন ও ইভিএম নিয়ে বিতর্ক ছিল, কিন্তু এমন বিপুল জয়ে কতকিছুই তো ভেসে যেতে বাধ্য।
ওই একইভাবে ২০২৪ সালেও মোদি সবকিছু এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবার ‘আব কি বার, ৪০০ পার’ স্লোগান দিয়ে শুরু করেছিলেন নির্বাচনী প্রচার। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট এবার ৪০০টির বেশি আসনে জয়লাভ করবে–এই বক্তব্য থেকে তাঁকে তিল পরিমাণ সরতে দেখা যায়নি। বরং বারবার ‘আব কি বার, ৪০০ পার’ বলে বলে একে স্বতঃসিদ্ধ করার চেষ্টা চলেছে ব্যাপকভাবে। এ কাজে প্রচারযন্ত্রগুলোর সহায়তাও পেয়েছে বিজেপির এনডিএ জোট। গত ১ জুন ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর যখন বুথফেরত জরিপের ফল আসতে শুরু করে, তখন সেই ফলেও দেখা গেছে, ৪০০টির বেশি আসনে জিততে যাচ্ছে এনডিএ। এমনটাই প্রচার হয়েছে বেশি। ফলে মানুষের মনে এই ধারণাটি গেঁথে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল যে, বিজেপিসহ এনডিএ এবার হয়তো চার শ’র নিচে নামবেই না!
অথচ সেই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ধারণাটিই এবার ভেঙে গেছে প্রায়। একেবারে ধরাশায়ী হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ফিনিক্স পাখির মতো যেন পুনর্জন্ম হলো কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধীদের। যে জোট কোনো প্রভাবই রাখতে পারবে না বলে এতদিন ছড়ানো হলো, তারাই এখন প্রায় ২৩০টিরও বেশি আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। ভারতের লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে সরকার গঠনের জন্য লাগে ২৭২টি আসনের নিয়ন্ত্রণ। এর বেশিসংখ্যক আসনেই এগিয়ে আছে মোদির বিজেপি ও এনডিএ। কিন্তু একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রবল প্রতাপ দেখানো দরকার হয়, সেটিই ফিকে হয়ে গেছে। চাইলেও মোদি বা তাঁর দল বিজেপি যে ভারতের মাটিতে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারবে না, অপ্রতিরোধ্য হতে পারবে না–সেটি প্রমাণ হয়ে গেছে। বিশেষ করে ভোটারদের এমন উল্টো রথে যাত্রায় মোদির হিন্দুত্ববাদী ভারত গড়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হওয়ার দশা। অর্থাৎ, ভারতীয়রা এটি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বৈচিত্র্যের সহাবস্থানে তারা বিশ্বাসী। কাউকে আর ‘একমাত্র’ হয়ে উঠতে দেওয়া হবে না। আর এটিই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। ফলে কেউ আর ক্ষমতার একচেটিয়া চর্চা করার সাহস পায় না।
মোদি ও তাঁর দল বিজেপির মূল এজেন্ডা আসলে এমন একটি ভারত গড়ে তোলা, যেখানে বৈচিত্র্য বলে কিছু থাকবে না। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে মোটে ২টি আসন পাওয়া বিজেপি সাংগঠনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) উত্তরাধিকারী। ভারতবর্ষ ভাগের পর এই চরম সাম্প্রদায়িক সংগঠনটিই ‘জনসঙ্ঘ’ নামে জাতীয় রাজনীতিতে পা রেখেছিল। জনসঙ্ঘই কালের পরিক্রমায় হয়েছে বিজেপি। ১৯৪৭ সালের পর যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে জনসঙ্ঘের অবস্থা ছিল সঙিন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ধীরে ধীরে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কল্কে পেতে শুরু করে। আর সেই সঙ্গে ঘৃণার আগুনে আহুতি দিয়ে ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে বিজেপি ওরফে আরএসএস। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধী শক্তিরও দায় অনেক। তাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিজেপিকে পাত্তা না দেওয়ার অযৌক্তিক নীতির কারণেই তলে তলে বড় হয়েছে ‘পদ্মফুল’। রাজনীতির হিসাব হলো, বিরোধী শক্তিকে সঠিক সম্মান দিয়ে আদর্শের ভিত্তিতে তার মোকাবিলা করে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে উঠতি একটি হুমকিকে আপনি ‘ছোট’ বলে হেয় করতে পারবেন না। তাতে আপনার অগোচরেই বেড়ে উঠবে আপনারই হন্তারক, অনেকটা ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’–এর মতো। আর ঠিক সেভাবেই বিজেপি শক্তিশালী হয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদির কাঁধে চড়ে প্রবল প্রতাপশালী হয়েছে।
কারণ আসলে সেই ‘পাত্তা’ না দেওয়ার ভুলই! ২০১৯ সালে কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধীরা ভেবেছিল, মোদি এবার ক্ষমতা থেকে যাবেনই। এই বাড়াবাড়ি আত্মবিশ্বাসের অহেতুক আত্মপ্রসাদই পতনের আশঙ্কাকে দৃষ্টিগোচর হতে দেয়নি। ঠিক একই ভুল এবার মোদি ও তাঁর দল বিজেপিসহ এনডিএ জোট করেছে। কংগ্রেসসহ ইন্ডিয়া জোটকে তারা গোণাতেই ধরতে চায়নি। আর সেই ফাঁকে মোদিদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার বিষয়টিতে ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে ইন্ডিয়া জোট। প্রচারযন্ত্রের দামামায় যে অসন্তুষ্টি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, সেটিই এখন হয়ে উঠেছে পথের কাঁটা। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটসহ জাতীয় অন্যান্য সংকট ওই কাঁটাকে করে তুলেছে যন্ত্রনাদায়ী। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করে মোদির মনে শান্তি ও সন্তুষ্টি আর ফিরছে না!
একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, সেই তো নরেন্দ্র মোদির জোটই নির্বাচনে জিতে যেতে পারে, মোদিই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন–তবে আর কী লাভ হলো! লাভ যেটা হলো, সেটা হচ্ছে—মোদি এখন আর একচেটিয়া হতে পারবেন না। চাইলেও না। একাধিক প্রতিরোধের মুখে তাঁকে প্রতিনিয়ত পড়তে হবে। লোকসভায় দুই শরও বেশি জনপ্রতিনিধির বিরোধিতার মুখে তাঁকে পড়তে হবে। আগে যেখানে নিজের ক্যারিশমা দিয়ে পার পেয়ে যেতেন মোদি, সেখানে তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে বারবার। আর কে না জানে যে, কোনো শক্ত গাছের গোড়ায় বারবার কুঠার চালালে এক না একদিন তা ধরাশায়ী হয়ই!
সুতরাং, নরেন্দ্র মোদি যে এবার কঠিন পরীক্ষায় পড়তে যাচ্ছেন, তা নিশ্চিত। কোনো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা পিওকে’তে চালানো বিমান হামলা এবার তাঁকে বাঁচাতে আসবে না। নিজের পরীক্ষায় নিজেকেই পাস করতে হবে। ফোর্থ সাবজেক্টের সুবিধা নেওয়া এ যাত্রায় বন্ধ। এক কথায়, মোদির ম্যাজিকের শেষের শুরু হয়ে গেছে। খাদের কিনারায় গিয়ে পায়ের ভারসাম্য তিনি ধরে রাখতে পারেন কিনা এবং সেখান থেকে ফিরে আসতে পারেন কিনা–সেটিই এখন দেখার!