ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
বুধবার ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
তানিয়া যেভাবে নিজের নাম-পরিচয় হারিয়ে ফেললেন
অর্ণব সান্যাল
প্রকাশ: Sunday, 28 January, 2024, 1:33 PM

তানিয়া যেভাবে নিজের নাম-পরিচয় হারিয়ে ফেললেন

তানিয়া যেভাবে নিজের নাম-পরিচয় হারিয়ে ফেললেন

প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা নাম থাকে। সেই নাম তার এক ধরনের পরিচয় বহন করে। রাষ্ট্র থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক যেকোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তাকে সেই পোশাকি নামে চেনে। পোশাকি নামের বাইরে ডাক নামও এই অঞ্চলে বেশ প্রচলিত। সেই নামে হয়তো পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা চেনে, বাবা-মা ডাকে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে যদি আপনার কোনো ভাই-বোন বা পরিবারের অন্য কারও আত্মীয় হিসেবে আপনি পরিচিত হতে থাকেন, তখন?

এমনটা যে একেবারে অস্বাভাবিক, তা নয়। আমাদের বয়স যখন বেশ কম থাকে, তখন কারও ছেলে বা মেয়ে হিসেবে আমরা পরিচিতি পাই। আরেকটু বড় হলে বা প্রাপ্তবয়স্ক হলেও কারও ভাই, কারও বোন অথবা কারও ছেলে-মেয়ে হিসেবে আমাদের পরিচিতি বহাল থাকে। তবে আমাদের বয়স যত বাড়তে থাকে, নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টির তাড়নাও তত বাড়ে। ধীরে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ ব্যক্তি হয়ে ওঠে এবং সেই ব্যক্তির একটি ব্যক্তিগত পরিচয়ও তৈরি হয়। সেটা যে শুধু পেশাকেন্দ্রিক হতে হবে, তা কিন্তু নয়। তবে এ দেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ সময় সেটিই হয়। তখন কিন্তু আপনি আর কারও ‘কিছু’ হিসেবে পরিচিত হতে চাইবেন না। বরং নিজের পরিচয়কেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন প্রাণপণে।

এটি আসলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও অস্তিত্ববাদেরই ফল। যেকোনো ব্যক্তিই নিজের বিশেষায়িত পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়। আর অস্তিত্ববাদ বারবারই বলে নিজের অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করতে, জল-হাওয়া দিয়ে সেটিকে বিশাল বটবৃক্ষ বানাতে। কিন্তু এই জায়গায় যদি আপনি দেখেন, উপযুক্ত হওয়ার পরও শুধু লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে আপনার সঙ্গীর পরিচয়েই আপনাকে চিনিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন কেমন হবে? এর মানে কিন্তু এই নয় যে, সঙ্গীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়াটা দোষের কিছু। কিন্তু যদি সেই পরিচয় আপনার নিজস্বতাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, তখনই সমস্যা।

এমনই একটি ঘটনা সম্প্রতি এ দেশে ঘটেছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন সংস্থা। কয়েকদিন আগেই জানা গেল, সৌদি আরবের পথে রওনা হওয়ার পর উইন্ডশিল্ডে ফাটল দেখা দেওয়ায় ২ ঘণ্টা উড়াল দেওয়ার পর রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফিরে এসেছে বিমান-এর একটি ফ্লাইট। উড়োজাহাজটি মাঝ আকাশে থাকা অবস্থায় পাইলট এটির উইন্ডশিল্ডে ফাটল দেখতে পেয়েছিলেন। ফ্লাইটটি এ সময় ভারতের আকাশসীমা অতিক্রম করছিল। এ অবস্থায় কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ক্যাপ্টেন ঢাকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বিমান-এর কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো আরও জানায়, ওই ফ্লাইটে ২৮৫ জন যাত্রী ও ১২ জন ক্রু ছিলেন। ঢাকা থেকে ওড়ার পর ফ্লাইট ক্যাপ্টেন ককপিটের কাচে ফাটল দেখতে পেয়ে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতের আকাশসীমা থেকে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন।

এইটুকু পর্যন্ত এটি খুবই সাধারণ একটি সংবাদ। উড়োজাহাজের এমন জরুরি অবতরণ ঘটে প্রায়ই, এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সেই উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম-পরিচয়ও জানা গেল, ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন তানিয়া রেজা। কিন্তু এরপর কেউ কেউ তাঁর ঘর-সংসারের খবরও নিতে গেলেন। এবং একপর্যায়ে জানা গেল, তিনি আমাদের চলচ্চিত্র জগতের ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, অর্থাৎ নায়ক ফেরদৌসের অর্ধাঙ্গিনী। আর এর পরই আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশের কাছে নিজের পেশাগত ও ব্যক্তিগত পরিচয় খুইয়ে ফেললেন ক্যাপ্টেন তানিয়া রেজা। তিনি হয়ে গেলেন শুধুই ফেরদৌসের স্ত্রী। এমনভাবে শিরোনাম করা হতে থাকল যে, মনেই হবে ক্যাপ্টেন বলে নয়, যেন ফেরদৌসের স্ত্রী বলেই তিনি উড়োজাহাজের উইন্ডশিল্ডে ফাটলটা দেখতে পেয়েছিলেন এবং উড়োজাহাজকে নিরাপদে অবতরণের ভাবনাটিও তাঁর মাথায় সেই কারণেই এসেছিল!

এমন ভাবনা অযৌক্তিক হলেও বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় খুবই প্রচলিত। আমাদের সমাজ দীর্ঘদিন ধরেই প্রচণ্ডভাবে পুরুষতান্ত্রিক। এই সমাজ যেকোনো কৃতিত্ব স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের কাঁধে চাপাতে চায়। নারীকে বঞ্চিত করতে এ সমাজের দুবার ভাবতে হয় না কখনোই। আর যদি–বা নারীকে কৃতিত্ব দিতেও হয়, তার সঙ্গে যুক্ত করতে চায় অনেক যদি-কিন্তু-তবে। এ কারণেই এ দেশের কর্মজীবী নারীদের বেশির ভাগেরই কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি ঘর-গেরস্ত সামলানোও একার কাজ হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষকে যে কেবল অর্থকরী মেশিন মনে করা হয়, ঘরের কাজ সেখানে বাড়তি এবং নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড। আর নারীর প্রধান কাজ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয় ঘরের কাজকে, এমনকি অর্থ রোজগার করে সংসারে বিনিয়োগ করা নারীকেও তা থেকে নিস্তার দেওয়ার কথা ভাবা হয় না। কারণ আমাদের সমাজ মনে করে, সন্তান বিপথে গেলে তার দায় কেবল মায়েরই। আর যদি সন্তান সুপথে থাকে, তবে তার কৃতিত্ব বাবাসহ পরিবারের সবার। মা সেখানে উপস্থিত থাকে বটে, তবে এক কোণায়। এ কারণে ঢালিউডের সিনেমাতে আমরা মায়ের উদ্দেশে বাবার বলা সংক্ষুব্ধ সংলাপ হিসেবে শুনি - ‘তোমার ছেলে’ বা ‘তোমার মেয়ে…’ দিয়ে শুরু করা বাক্য। আর ভালো কিছুর বেলায় শোনা যায়, ‘বাপ কা বেটা, সিপাই কা ঘোড়া…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

অভিনেতা ফেরদৌস ও তাঁর স্ত্রী পাইলট তানিয়া রেজা। ছবি: সংগৃহীতঅভিনেতা ফেরদৌস ও তাঁর স্ত্রী পাইলট তানিয়া রেজা। ছবি: সংগৃহীত
এসব দৃষ্টিভঙ্গিতেই হয়তো ক্যাপ্টেন তানিয়া রেজা পরিচিতি পান নায়ক ও হালের সংসদ সদস্য ফেরদৌসের স্ত্রী হিসেবে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত দক্ষতা ও পরিচয় সেখানে আড়ালে চলে যায় অবলীলায়। এটি যদি শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া পোস্ট হতো, তা-ও নাহয় সমাজের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে চোখ বুজে থাকা যেত। কিন্তু যখন রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলোও এর পালে হাওয়া দিতে থাকে, তখন আসলে কিছুটা অসহায় বোধ হয়। সংবাদমাধ্যমের কাজই হচ্ছে অসঙ্গতি তুলে ধরা, সঠিক পথে জাতিকে এগিয়ে যেতে দিকনির্দেশনা দেওয়া। সেটি না করে সংবাদমাধ্যমগুলো যখন ক্লিক ও সোশ্যাল ইন্টারেকশন অর্জনের ইঁদুর দৌড়ে শামিল হওয়াকেই নিজেদের একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে করতে থাকে এবং কেবল এসইও ভলিউম বেশি থাকার কারণকেই উপযুক্ত মনে করে একজন নারীর মূল পরিচয় হিসেবে তিনি কার স্ত্রী, সেটিকেই শিরোনামে তুলে ধরার চেষ্টা করে—তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, স্খলন অদ্য দেশের সকল ক্ষেত্রেই নিজ প্রভাব প্রবলভাবেই বিস্তার করতে পেরেছে। এখানে সামাজিক দায় বলতে আর কিছু নেই। আছে কেবল ‘আমার নিউজটা পাবলিক সেই খেয়েছে’ টাইপের মেকি গৌরব।


বলতেই পারেন যে, কত কী হয়ে যাচ্ছে, এতে আর তেমন কী ক্ষতিটা হয়েছে! আসলে এই ক্ষতি অনেকটা ‘সাইলেন্ট কিলার’ ঘরানার। হয়তো এই ধরনের সংবাদ পড়ে বা দেখেই, এ দেশের কোনো এক পুরুষ বাড়িতে ফিরে নিজের কর্মজীবী স্ত্রীকে একদিন বলে বসবেন—‘যতই চাকরি করো, তোমাকে সবাই চেনে তো আমাকে দিয়েই!’ তার বেলা? এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো নিজের নাম-পরিচয় হারিয়ে ফেলতেই থাকবেন আমাদের মা-বোন-প্রেয়সীরা। আর কে না জানে, এই বস্তুবাদী পৃথিবী কেবলই পরিচয়ের কাঙাল।

এর চেয়ে বরং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমোঘ বাণীতেই একটু ভরসা করা যাক। একটু মেনে নেওয়া যাক যে, শুধু পুরুষেরাই সব কিছু্র নির্মাতা নন। নারীদেরও তাতে অবদান প্রবলভাবেই। এ দেশের সমাজ থেকে শুরু করে আপামর পুরুষ ও ক্লিকবেইটের নেশায় আসক্ত সংবাদমাধ্যমগুলো সেটি যত সহজে মেনে নিতে পারবে, ততই মঙ্গল। নইলে কিন্তু একসময় এ দেশে পুরুষ ছাড়া কোনো পিঁপড়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না!

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status