বাড়ির দাম এক কাপ কফির চেয়েও কম, ইতালির ‘এক ইউরোর’ শহরে জীবন যেভাবে কাটে
নতুন সময় ডেস্ক
|
![]() বাড়ির দাম এক কাপ কফির চেয়েও কম, ইতালির ‘এক ইউরোর’ শহরে জীবন যেভাবে কাটে রাস্তাগুলো বড়দিনের মতো ঝলমল করছে; খিলানগুলোতে জ্বলছে নিয়ন নীল, সাদা, সবুজ আর লাল রঙের আলো। গির্জার বারোক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি ক্রিমরঙা পাথরের সম্মুখভাগ বিশেষভাবে আলোকিত করা হয়েছে। দরজার ওপরে পবিত্র নীল রঙে লেখা 'W MARIA', অর্থাৎ 'মেরি দীর্ঘজীবী হোন'। এরপর তিনি এলেন—ভার্জিন মেরির একটি কাঠের মূর্তি। শহরবাসীর দান করা মহামূল্যবান স্বর্ণালংকারে প্রায় পুরোটাই ঢাকা। প্রায় ছয় ফুট উঁচু মূর্তিটি একটি বিশাল কাঠের মঞ্চের ওপর বসানো, যা বহন করতে প্রয়োজন হয় প্রায় ২০ জন পুরুষের। তারাই মূর্তিটি কাঁধে নিয়ে গির্জার সিঁড়ি বেয়ে নামেন, তারপর খাড়া রাস্তা দিয়ে শহরের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যান। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে, একটি বাদক দলের সঙ্গীত এবং থেকে থেকে জ্বলে ওঠা আতশবাজির ঝলকানির মধ্য দিয়ে, হাজার হাজার অনুসারীকে সঙ্গে নিয়ে মূর্তিটি পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই শহরের উঁচু-নিচু এবং সর্পিল পথ প্রদক্ষিণ করে। সিসিলির এই শহরের জীবনযাত্রার সঙ্গে এভাবেই পরিচিত হচ্ছেন নতুন বাসিন্দারা। কারণ, এটিই সেই বিখ্যাত 'এক ইউরোর শহর'। এখানকার জীবনযাত্রা দারুণভাবে স্থানীয় ঐতিহ্যনির্ভর, যার মূলে রয়েছে সামাজিক বন্ধন। আর এই বন্ধনেরই অংশ হতে এখন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছেন। ইতালির যে শহরগুলো মাত্র এক ইউরোতে পুরোনো ভাঙাচোরা বাড়ি বিক্রি করছে, তার মধ্যে সিসিলির মুসোমেলিই সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত। এক কাপ কফির চেয়েও কম দামে একটি বাড়ি! কথাটি শুনলে কৌতূহল বা অবিশ্বাসে যে কারও ভ্রু কুঁচকাবে। বাড়িটির অবস্থা না জানি কতটা জরাজীর্ণ? আদৌ কি সেখানে কেউ বাস করে, নাকি সভ্যতা থেকে বহু দূরে পাহাড়ের বুকে প্রায় পরিত্যক্ত কোনো গ্রাম? তবে মুস্সোমেলির জনপ্রিয়তার কারণ হলো, এখানে তেমন কোনো শুভঙ্করের ফাঁকি নেই। প্রায় পাঁচ হাজার বাসিন্দার এই শহরটি এখনও প্রাণবন্ত। এখানে হয়তো বড় ব্র্যান্ডের দোকানপাট নেই, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই হাতের নাগালে। ডাক্তার, সুপারমার্কেট, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে—সবই রয়েছে। শহরটির সামাজিক জীবনও বেশ রঙিন। গ্রীষ্মকালে প্রায় প্রতি রাতেই শহরের চত্বরগুলো লাইভ মিউজিকে মুখর হয়ে ওঠে। এছাড়াও বছরজুড়ে চলতে থাকে বিভিন্ন ক্যাথলিক ধর্মীয় শোভাযাত্রা, যার মধ্যে ৮ সেপ্টেম্বরের 'লা ম্যাডোনা দি মুস্সোমেলি' উৎসবটি সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয়। সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে মুসোমেলি কোনো মৃতপ্রায় বা হারিয়ে যাওয়া শহর নয়! এই প্রকল্পটি চালু করেছে স্থানীয় রিয়েল এস্টেট এজেন্সি 'এজেনজিয়া ইমমবিলিয়ারে সিসিলিয়ানা'। এজেন্সির কর্মকর্তা সিনজিয়া সোর্সের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে শহর পরিষদ প্রথম ধাপে কিছু বাড়ি বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত করে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫০টি বাড়ি বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে ১৫০টিই হলো সেই এক ইউরোর বাড়ি। বিশ্বজুড়ে ইতালি বলতে মানুষের মনে ভেসে ওঠে নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত আর শিল্পকর্মে ঠাসা সব প্রাচীন শহরের ছবি। কিন্তু যারা মুসোমেলিকে বেছে নিচ্ছেন, তারা মূলত আসছেন এখানকার মানুষের উষ্ণতার টানে। মুসোমেলির বাসিন্দাদের জন্য 'আকোলিয়েনজা' বা বাইরের মানুষকে স্বাগত জানানোটা তাদের জীবনেরই একটি অংশ। এই আন্তরিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মারিয়া আনা ভ্যালেন্সা। শহরে যখনই কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠান হয়, নিশ্চিতভাবেই ভ্যালেন্সা তার অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত থাকেন। মুসোমেলির মেয়র, জিউসেপ্পে কাতানিয়া বলেন, 'পুরো সিসিলিয়ার মানুষই খোলামেলা এবং অতিথিপরায়ণ, কারণ আমরা দীর্ঘদিন বিদেশি শাসনের অধীনে ছিলাম। নতুন জনগোষ্ঠীকে স্বাগত জানানো এবং তাদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা আমাদের ডিএনএ-তে মিশে আছে।' তিনি স্বীকার করেন, কয়েক দশক আগেও সিসিলির এই অভ্যন্তরীণ অংশটি বেশ রক্ষণশীল বা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকা ছিল, কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এর একটি কারণ প্রযুক্তি, যা বাইরের জগৎকে ভেতরে নিয়ে এসেছে; আরেকটি কারণ হলো, এখনকার তরুণেরা অনেক বেশি ভ্রমণ করে। তবে এর পাশাপাশি এক ইউরোর বাড়ি বিক্রির প্রকল্পটিও বড় ভূমিকা রেখেছে। এক ইউরো যেভাবে বদলে দিল শহরকে মেয়র কাতানিয়া জানান, এক ইউরোর এই আবাসন প্রকল্পটি শহরের উপর বিশাল প্রভাব ফেলেছে। ২০১৫ সালে তিনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন শহরের পুরোনো অংশ প্রায় খালি হয়ে যাচ্ছিল এবং জনসংখ্যাও ক্রমশ কমছিল। একসময় যে শহরের বাসিন্দা ছিল প্রায় ১৮ হাজার, যুদ্ধোত্তর সময়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক অভিবাসনের কারণে তা কমতে থাকে। পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রটি দেখতে সুন্দর হলেও, এর খাড়া ও সংকীর্ণ রাস্তাগুলো বসবাসের জন্য খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। ফলে, ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে শহরের ওপরের সমতল অংশে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক তৈরি হলে, পরিবারগুলো পুরোনো শহর ছেড়ে নতুন শহরে চলে যেতে শুরু করে। মেয়র কাতানিয়া যখন নির্বাচিত হন, তখন শহরের কেন্দ্রস্থল ছিল প্রায় জনশূন্য। তিনি বলেন, 'আমরা এমন একটি ঐতিহাসিক কেন্দ্রের মুখোমুখি হয়েছিলাম, যার সংস্কার এবং পুনরায় জনবসতি স্থাপন করা জরুরি ছিল।' আট বছর পর, সেই প্রকল্প সফল বলে মনে হচ্ছে। এখন শহরে স্থায়ীভাবে ১৮টি ভিন্ন দেশের নাগরিক বাস করছেন। মেয়র জানান, দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০২৩ সালে শহরের জনসংখ্যা ১০ বছর আগের জনসংখ্যার সমান হয়েছে। এই প্রকল্প স্থানীয় অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করেছে। নির্মাণকর্মীদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। প্রকল্পের হাত ধরে শহরে নতুন নতুন থাকার জায়গা এবং রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে। মুস্সোমেলি এখন পর্যটন মানচিত্রেও জায়গা করে নিয়েছে। মেয়র জানান, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বার্ষিক নিবন্ধিত পর্যটকের সংখ্যা ৯১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিনজিয়া সোর্স বলেন, 'এই এক-ইউরোর প্রকল্পটি আমাদের জন্য সেরা একটি উদ্যোগ। এটি আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন এনেছে, চিন্তাধারাকে উন্মুক্ত করেছে এবং কুসংস্কার ভেঙে দিয়েছে।' প্রাথমিকভাবে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে, বাইরে থেকে কেমন ধরনের মানুষ আসবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব বিদেশিই এখানকার জীবনধারা ও ঐতিহ্যকে আপন করে নিয়েছেন। বারবারা মার্কল বলেন, 'এখানে প্রতি কয়েক সপ্তাহ পর পরই কোনো না কোনো সাধুর সম্মানে উৎসব হয় এবং শহরজুড়ে শোভাযাত্রা বের হয়। এই অভিজ্ঞতাগুলো সত্যিই অসাধারণ।' মেয়র কাতানিয়া, যিনি রোম এবং বোলোনিয়ার মতো বড় শহরেও থেকেছেন, মুস্সোমেলিকে অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে বদলাতে রাজি নন। তিনি বলেন, 'এমনকি যখন আমি ২০ বছর ধরে এগ্রিজেন্তোতে (এক ঘণ্টার দূরত্ব) কাজ করেছি, তখনও আমি প্রতিদিন বাড়ি ফিরে আসতেই পছন্দ করতাম। আমি ফিরে এসেছি, কারণ আমি মুস্সোমেলির প্রেমে পাগল ছিলাম।' মনে হচ্ছে, এই প্রেমে তিনি একা নন। |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |