ডুবোচর আটকে দেয় পথ, তাপবিদ্যুৎ পুড়িয়ে ফেলে প্রাণ ইলিশ আর নেই,নদী নীরব, পেট খালি
তামান্না জেনিফার, বরগুনা:
|
![]() ডুবোচর আটকে দেয় পথ, তাপবিদ্যুৎ পুড়িয়ে ফেলে প্রাণ ইলিশ আর নেই,নদী নীরব, পেট খালি পায়রা নদীর বুক এখন যেন এক জীবন্ত শোকগাথা। যে নদী একসময় রূপালী ইলিশের কলতানে মুখরিত ছিল, আজ সেখানে নিঃস্তব্ধতা, জাল ভিজে ওঠে, কিন্তু ফিরে আসে খালি। নলবুনিয়ার আলমগীর হাওলাদার চোখে জল নিয়ে বলেন: "নদীটা আমাদের মা ছিল… এখন সেই মা-ই নিঃস্ব। মাছ নাই, আয় নাই, ঘরে চাল নাই। আমরা বাঁচি কীভাবে বলেন?" বরগুনার পায়রা নদীতে ভরা মৌসুমেও রূপালী ইলিশের দেখা নেই। যেখানে জুলাই মাসে নদীজুড়ে জেলেদের জালে ঝলমলে ইলিশ লাফিয়ে পড়ার কথা, সেখানে এখন জাল ভেজে শুকাতে হয়। কারণ সাগর মোহনায় ডুবোচর আর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম পানি ও বর্জ্য। জেলেদের দাবি, এই দুই কারণেই পায়রা নদীতে ইলিশের স্বাভাবিক প্রবেশ ও প্রজনন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বহু ইলিশ সাগর থেকে নদীতে ঢোকার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উল্টো দিকে ফিরে যাচ্ছে। এর দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না। নদীর গায়ে ক্ষত: ডুবোচরের বিস্তার বুড়িশ্বর বা পায়রা নদীর মোহনায় আশার চর, নলবুনিয়া, পদ্মা ও কুমিরমারা এলাকায় ২০ কিলোমিটারের বেশি বিস্তৃত ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। পরিণতিতে জোয়ারের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। জোয়ারের পানি কম প্রবেশ করায় নদীতে গভীরতা কমছে, ফলে ইলিশ চলাচলের পথ হয়ে উঠছে অসম্ভব বিপদসংকুল। জেলেরা বলেন, “জোয়ার এলেও এখন আগের মতো পানি আসে না। ইলিশ আসতে না পেরে ফেরত চলে যাচ্ছে। নদীতে জাল ফেলেও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।” গরম পানি, বিষাক্ত বর্জ্য আর ইলিশের দুঃস্বপ্ন ২০১৯ সালে তালতলীর জয়ালভাঙ্গায় নির্মিত আইসোটেক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০২২ সালে উৎপাদনে গেলে পায়রা নদীর বিপর্যয় শুরু হয়। কেন্দ্রটি প্রতিদিন গরম পানি ও বর্জ্য নদীতে ছাড়ছে। ফলে নদীর পানির তাপমাত্রা বেড়েছে, পিএইচ ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, প্রাকৃতিক খাদ্যচক্র ভেঙে পড়েছে। ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, “ইলিশের চলাচল ও প্রজননের জন্য গভীর, ঠাণ্ডা ও নির্মল পানি দরকার। কিন্তু পায়রা নদী এখন গরম, অগভীর ও দূষিত ইলিশের চলার পথ এ যেন এক মরুভূমি।” ১৪,৬৮৯ জেলে আজ পেটের দায়ে মরিয়া বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলীতে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৮৯ জন। এদের অনেকেই দিনমজুর, কেউবা ঋণ নিয়ে ট্রলার কিনেছে, কেউ মাছ বিক্রির টাকায় সংসার চালায়। এবারের মৌসুমে ইলিশ না পাওয়ায় পরিবারগুলো ভাঙনের মুখে। তালতলীর জেলে ছত্তার বলেন, “মাছ ছাড়া আমরা কিছুই পারি না। ইলিশ আসবে বলে ঘর থেকে বের হই, এখন নদীতে গিয়ে বসে থাকি, কিন্তু জাল খালি। ছেলে-মেয়েদের মুখ চেয়ে চোখের পানি ফেলি।” প্রশাসনের নীরবতা ও উদাসীনতা জেলেদের অসহায়ত্ব, নদীর নাব্য সংকট, ইলিশ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সবকিছু প্রশাসনের চোখের সামনেই ঘটছে। তবুও নেই কার্যকর ডুবোচর খনন, নেই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। তালতলীর সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন বলেন, “সাগর মোহনায় ডুবোচরের কারণে নদীর নাব্য হারিয়েছে। ইলিশ স্রোতের সঙ্গে আসলেও মাঝপথে বাধায় ফেরত যায়।” করণীয় কী? · ডুবোচর খনন: পায়রা নদীর মোহনায় জরুরি ভিত্তিতে খনন করতে হবে। · তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তদারকি: বর্জ্য ও গরম পানি নিষ্কাশন মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। · জেলেদের সহায়তা: সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। · পরিবেশ অধিদপ্তরের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। পায়রা নদী শুধু একটি জলাধার নয়, এটি উপকূলের হাজারো মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি। এই নদীকে রক্ষা করতে না পারলে, হারিয়ে যাবে রূপালী ইলিশের সাথে একটি অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব।
|
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |