বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়লেও আয় না বাড়ার কারণে পরিচালন ব্যয়ের পর ঋণ শোধ করা নিয়ে সরকারকে অনেকটা টানাপোড়েনের মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এমন অবস্থায় সরকারের হাতে কী ধরনের বিকল্প রয়েছে তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। অনেকে বলছেন, ঋণের ‘রিফাইনান্সিং’ করে সময় বাড়ানো এবং ব্যয় কমানো একটা বিকল্প হতে পারে।
এর সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে অনেক অর্থনীতিবিদ আবার বলছেন, সরকার যদি ঋণের চক্রে পড়তে না চায় তাহলে আয় বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের পর থেকে গত ১৪ বছরে এটি ৩২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর গত তিন বছরে এটি ৩৩.৬ শতাংশ বেড়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আয় না হওয়ার কারণে সরকারের আয় কমে গেছে।
অর্থ সংকটের কারণে সবশেষ সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের জন্য বিশেষ ধরনের বন্ড ছাড়ার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এটিও এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ঋণ।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ ব্যবস্থাপনায় নতুন কৌশল প্রণয়ন করতে চাইছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, এতে সহায়তা করতে চলতি মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের একটি যৌথ কারিগরি দল বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
রাজস্ব আয় কত?
চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংগ্রহ করবে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ অন্য উৎস থেকে সংগ্রহ করার কথা রয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই অর্থবছরে সব মিলিয়ে তিন লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা হয়। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছিল।
রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১২ শতাংশ। যাকে গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি বলে ধরা হচ্ছে।
সেই অর্থবছরে ভ্যাট খাতে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আয় হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি ছিল।
২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছিল সব মিলিয়ে তিন লাখ ২ হাজার কোটি টাকা।
সরকারের ঋণ কত?
একটি দেশের বিদেশি ঋণ হচ্ছে, ওই দেশটি বিভিন্ন দেশ, বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে ঋণ নেয় সেটি।
বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিদেশি বাণিজ্য ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটারনাল ডেট জানুয়ারি-জুন ২০২৩ নামে প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮.৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮২.৯০ বিলিয়ন ডলার। আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ ১৬.০৩ বিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের জুনের তুলনায় ২০২৩ সালের জুনে মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩.৬৫ শতাংশ বেড়েছে।
গত বছরের জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ৭৬.৬৮ শতাংশ।
এ খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার (৬৪.৫৭ বিলিয়ন ডলার)। এর পরেই আছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান (৭ বিলিয়ন ডলার), কেন্দ্রীয় ব্যাংক (৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার) এবং এনসিবি ব্যাংক (০.৬৫ বিলিয়ন ডলার)।
আর বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ২২.২৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই খাতে ঋণের পরিমাণ ১৪.২৩ শতাংশ বেড়েছে।
বেসরকারি খাতে বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিয়েছে।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৭৯.৩১ মার্কিন ডলার।
গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৬২ হাজার ৩১২ দশমিক ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
শুধু বৈদেশিক ঋণ নয়। অভ্যন্তরীণ নানা উৎসেও ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফ এর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৭.৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ৬ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে দুটি পথ আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি আয় বাড়ানো। এই আয়ের মধ্যে রয়েছে কর থেকে আয় এবং কর বহির্ভূত আয়। এই আয় বাড়িয়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণকে পরিশোধ করা। একে ‘রিফাইনান্সিং’ বলা হয়।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ধরা যাক ১০০ টাকার একটি ঋণ যা আগামী বছর পরিশোধ করার কথা রয়েছে। তো আগামী বছর আবার আরেকটি ১০০ টাকার ঋণ নিয়ে আগেরটি পরিশোধ করা হলো। এতে নতুন ঋণটি পরের বছর পরিশোধ করতে হবে বিধায় কিছুটা অতিরিক্ত সময় পাওয়া গেলো।
এই দুটি উপায় ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের হাতে আর কোনো পথ নেই বলে মনে করেন তিনি।
রাজস্ব আয় যদি বাড়ানো সম্ভব না হয় তাহলে এর বিকল্প হতে পারে সরকারের ব্যয় কমানো।
“রেভিনিউ যদি না বাড়াতে পারে, তার খরচ যদি সে কমাতে পারে, তাহলে একই রেভিনিউ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব”, বলেন তিনি।
তবে এসব পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে সরকারের আয় বাড়ানোর দিকেই নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “নতুন ঋণ নিয়ে রিফাইনান্সিং তো বার বার করতে পারবেন না। আর রিফাইনান্সিং করে তো আপনি প্রবলেমটাকে পোস্টপোন করছেন, সলভ করছেন না।”
তৃতীয়ত, সরকারের ব্যয়কে যৌক্তিকীকরণ বা অপচয় কমানোর ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
এক্ষেত্রে সরকারের মেগা প্রকল্পসহ সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় যাতে যৌক্তিক হয় তা পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মি. হোসেন বলেন, সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে যে মূল্যে পণ্য ও সেবা কিনে থাকে তা বাজারমূল্যের সাথে মেলালে সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বহুল আলোচিত ‘পর্দা ও বালিশ কাণ্ডের’ কথা উল্লেখ করেন।
“দুর্নীতির কারণে সরকার অনেক অতিরিক্ত ব্যয় করে। উন্নয়ন প্রকল্পে কস্ট ওভাররানের (ব্যয়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া) ইতিহাস তো নতুন কোনো ইতিহাস না। একটা ১০০ টাকার প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শেষে দেখা যায় যে ৩০০, ৪০০ টাকা হয়ে গেছে। এখানে মিস প্রাইসিং ও ওভারপ্রাইসিং বড় বিষয়।”
এছাড়া সরকারি যেসব ব্যয় না করলে তেমন কোনো অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে না এমন ব্যয় কমানো যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান নির্বাহী আহসান এইচ মনসুর অবশ্য মনে করেন, সরকারি ব্যয় কমিয়ে আসলে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।
তার মতে, শুধুমাত্র সরকারের আয় অর্থাৎ রাজস্ব বাড়ানোর মাধ্যমেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, “বিকল্প একটাই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে রাজস্ব বাড়াতে হবে। ধার করে বেশি দিন ঘি খাওয়া যায় না।“
বাংলাদেশের রাজস্ব না বাড়ার পেছনে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং প্রক্রিয়াগত জটিলতা থাকাকে দায়ী করেন তিনি।
তাই রাজস্ব খাতে মৌলিক সংস্কার আনা না হলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হবে না। আর এটা যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
“এখন করলে তিন থেকে পাঁচ বছর পরে ফল পাওয়া যাবে। সময় লাগবে।”
মি. মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায়ের পুরো বিষয়টিকেই ঢেলে সাজাতে হবে। রাজস্ব জমা দেয়ার প্রক্রিয়ায় যাতে কোনোভাবেই সরকারি কোনো কর্মকর্তার সাথে রাজস্ব পরিশোধকারীর যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে।
এর মাধ্যমে দুর্নীতি কমবে এবং সরকার লাভবান হবে বলে মনে করেন তিনি।
“ট্যাক্স পেয়ারের সাথে ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হবে না। ঘুসের আদান-প্রদান যাতে বন্ধ হয়ে যায়।”
“তাহলে ঘুসে খেয়েই সব মেরে দেয়, সরকারের কাছে কিছু যায় না। প্রচুর হয়রানি হয়, পরে একটা কম্প্রোমাইজ হয়, পরে সরকার লুজার হয়”, যোগ করেন মি. মনসুর।
তিনি বলেন, সরকার বড় পরিবর্তনের মাধ্যমে যদি রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারে তাহলে ঋণ আরো বাড়তে থাকবে, মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন অতিরিক্ত টাকা ছাপাতে হবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির হার ২১.৪৮ শতাংশ। সরকার অবশ্য বলছে যে, যেহেতু ঋণ-জিডিপির হার ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত নিরাপদ মনে করা হয়, তাই ঋণ নেয়ার আরো সুযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশে নিরাপদ অবস্থানেই রয়েছে।
তিনি বলেন, ঋণ-জিডিপির হার আসলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। এটি দিয়ে তেমন কোনো কিছু বোঝায় না। জিডিপির একশ টাকার মধ্যে সরকারের ভাগ হচ্ছে ৭-৮ টাকা। ঋণ-জিডিপি দিয়ে কী হবে?
তার মতে, আয়ের তুলনায় সরকারের ঋণের হার কত সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আয় বা রাজস্ব দিয়েই ঋণ পরিশোধ করা হয়ে থাকে। জিডিপি দিয়ে নয়। কারণ জিডিপির অর্থ সরকারের নয়। সেটা জনগণের। আর এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো নয়। কারণ আয়ের তুলনায় ঋণের হার অনেক বেশি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজস্ব হার কম হওয়ার কারণে অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না বলেও মনে করেন মি. মনসুর।