ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
হয় বিসিএস, নয় বিদেশ—এই কি তবে তরুণদের স্বপ্ন?
নতুন সময় ডেস্ক
প্রকাশ: Sunday, 31 December, 2023, 2:08 AM

হয় বিসিএস, নয় বিদেশ—এই কি তবে তরুণদের স্বপ্ন?

হয় বিসিএস, নয় বিদেশ—এই কি তবে তরুণদের স্বপ্ন?

কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হলো ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল। শুরু হয়ে গেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ ও অভিনন্দন জানানোর বন্যা। একজনের চাকরি প্রাপ্তিতে এমন উল্লাসে দোষের কিছুই নেই। বরং এটি আনন্দিত হওয়ার মতোই খবর। কিন্তু বিসিএসের বা বিশেষ করে সরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে যে ঘরানার অভিনন্দন জানানো হয়, তার প্রকৃতি অনেকটা—‘যাক, অমুকের জীবনের একটা গতি হলো’ ধরনের!


অর্থাৎ, আমাদের দেশের আপামর জনগণের অধিকাংশই এখন সরকারি চাকরি পাওয়াকে জীবনের মোক্ষ অর্জনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সমাজ বা মুরুব্বিরাই ‘গাইড’ হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। এর প্রমাণ পেতে নিজেদের পারিবারিক কাঠামোয় খোঁজ নিলেই হবে। বুঝে যাবেন, আমাদের মুরুব্বি সমাজের একটি বিরাট অংশ এই সরকারি চাকরিকে তাদের উত্তরসূরীদের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করতে কতটা মরিয়া।

এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবেই যুক্ত হয়েছে সরকারি খাতে পাওয়া এন্তার সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সহজে চাকরি না হারানোর নিশ্চয়তা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলো এখন বিসিএসের প্রস্তুতি নেওযা আঁতুড়ঘর হয়ে গেছে। এর জন্য গত কয়েক বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির অবস্থার ছবি দেখলেই যথেষ্ঠ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসব ছবি প্রায় সময়ই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা দেখেছি সাত সকাল থেকেই বিসিএসের গাইড বই হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সিট দখলের লড়াই কতটা তীব্র। এমনকি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রায় ১০/১২ বছর আগে থেকেই এই ট্রেন্ডের উৎপত্তি। দিন দিন তা তীব্র হয়েছে। কে জানে, হয়তো এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় অমুক দেশের রাজধানীর নাম মুখস্ত বা স্রোতের বিপরীতে নৌকার গতিবেগ নির্ণয়ের সংগ্রাম!


মোদ্দা কথা, এ দেশের তরুণদের শিক্ষা অর্জনের অন্যতম কারণ হিসেবে উত্থান ঘটেছে সরকারি কর্মচারী হওয়ার মোহ। বিভিন্ন জরিপেও এর প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের সঙ্গে মিলে একটি জরিপ করেছে বাংলাদেশ ইউথ লিডারশিপ সেন্টার। এ দেশের তরুণ-তরুণীদের ভাবনা বুঝতেই মূলত এই জরিপ। শিরোনাম, ‘ইউথ ম্যাটারস সার্ভে ২০২৩’। ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সের তরুণ-তরুণীরা এই জরিপে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রায় ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী সবেতনে চাকরি পেতে চায়। বাকিরা চায় উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে। আবার যারা চাকরি করতে চায়, তাদের ৬২ দশমিক ৩ শতাংশই চায় সরকারি চাকরি।

জরিপের এই ফলাফলে স্পষ্ট যে, আমাদের তরুণদের খায়েশ আসলে কেমন। আরেকটি হিসাব দেখলে বোঝা যাবে যে, আমাদের তরুণেরা এখন শুধু রোজগারের আশাতেই পড়াশোনাটা করছেন। এই ‘ইউথ ম্যাটারস সার্ভে ২০২৩’ নামের জরিপেই প্রায় ৭০ শতাংশ তরুণ-তরুণীর মত হলো, দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ভবিষ্যৎ চাকরির বাজার বা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার উপযোগী নয়। অর্থাৎ, এর জন্য প্রযোজনীয় যেসব দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সেগুলো বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সরবরাহ করতে পারছে না।

এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যে বিতর্কটি ওঠে, সেটি হলো—শিক্ষার দর্শন জ্ঞাননির্ভর হওয়া উচিত, নাকি ভবিষ্যতের আয়নির্ভর? এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিতর্ক। যেমনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। ব্যাপারটি হলো—বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জনের রাস্তাগুলো দেখিয়ে দেবে, কিন্তু জ্ঞান গিলিয়ে দেবে না। এখন এই গাইড করার প্রক্রিয়াটি আদৌ এ দেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ কিনা, সেই সন্দেহ রাখাই যায়। প্রশ্ন তোলা যায় সংশ্লিষ্ট সিলেবাস কতটুকু আধুনিক, তা নিয়েও। এসব পরিবর্তনের উদ্যোগও নেওয়া যায়। কিন্তু এটি কি বলা যায় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে বের হওয়ামাত্র আপনি চাকরির বাজারে সফল হলেই সেই শিক্ষাকাঠামো বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া সফল? যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার সফলতা কি চাকরির বাজারে সফল হওয়া দিয়েই নির্ধারিত হবে? অন্তত যে মূল নৈতিক উদ্দেশ্য বা দর্শন নিয়ে এই পৃথিবীতে শিক্ষা বিতরণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়েছিল, তার সঙ্গে আয় নিশ্চিতের ভাবনা বেশ দূরবর্তী ছিল বলেই বোধ হয়।

কিন্তু এ দেশে এখন সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষালাভের অন্যতম অনুপ্রেরণা। শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে ফেলার এই খেলাটা পুরোনো। এবং এর কারণে শিক্ষা শেষ পর্যন্ত রোজগারের হাতিয়ারই হয়ে থাকছে কেবল, মানুষ বা মানবিক হওয়ার নয়। তাই আমাদের দেশেও শিক্ষিত ব্যক্তির তুলনায় সত্যিকারের জ্ঞানী ও গুণী মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক কম।

এবার আসা যাক বিদেশ যাওয়ার প্রসঙ্গে। জরিপ অনুযায়ী, ৪২ শতাংশের বেশি তরুণ-তরুণী দেশের বাইরে স্থায়ী আবাস গড়তে চায়। এর কারণ হিসেবে তারা দক্ষতা অনুযায়ী উপযুক্ত চাকরি পাওয়ার অনিশ্চয়তা, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উপযোগী পরিবেশের অভাব, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের কম সুযোগ, অনিশ্চিত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। এই সবগুলো কারণ এ দেশে একেবারেই অনুপস্থিত—সেটি বলার সুযোগ নেই কোনোভাবেই। তবে এর বাইরে সামাজিক মর্যাদাজনিত একটি কারণও আছে। ধরুন, আপনার সন্তান সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণটি ধরতে পারল না। বেসরকারি চাকরি বা উদ্যোক্তা হওয়ার বদলে আপনি তখন চান, ‘ছেলে বা মেয়ে অমুক দেশে আছে’ বলতে। কারণ ওতে সন্তানের অধিক আয় করার বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করা যায় বা ইঙ্গিত দেওয়া যায়। এবং এ কারণে সন্তানদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের চাপও দেওয়া হয় বলেই বোধ হয়।

তারপরও বলবেন, তরুণেরা কেন বিসিএস জ্বরে ভুগছে?তারপরও বলবেন, তরুণেরা কেন বিসিএস জ্বরে ভুগছে?

অর্থাৎ, আমরা আমাদের সকল উদ্দেশ্য-বিধেয় বা লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে অবধারিতভাবে মিশিয়ে দিচ্ছি আয়-রোজগারের বিষয়টি। যাতে আয় নেই, সেটি আসলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। হয়তো ঠিক এই কারণেই এ দেশের তরুণ-তরুণীরা এখন হয় বিসিএস, নয় বিদেশ—এমন লক্ষ্য অর্জনকেই জীবনের পাথেয় করে তুলছে। কারণ যত যাই বলুন, একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তৈরিতে পরিবার ও সমাজের এবং এর পারিপার্শ্বিকতার ভূমিকা ঢের। অস্তিত্ববাদের হিসাবে প্রত্যেকটা মানুষই নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে এবং সেই অস্তিত্বকে প্রকট করে তুলতে আগ্রহী থাকে। যখন আপনার সমাজ ও পরিবার শুধু উপার্জনকেই অস্তিত্বের সমার্থক হিসেবে তুলে ধরবে, তখন এক পর্যায়ে চেতনে বা অবচেতনে আপনিও সেটিতে গা ভাসাবেন বৈকি।


যদিও এই প্রক্রিয়ার সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাব অনেক। এভাবে দীর্ঘদিন চললে, এমন একটি জাতিই গড়ে উঠবে, যার মূল হবে শুধুই অর্থ। এটিই হবে সোনার কাঠি, এটিই হবে রূপার কাঠি। ন্যায় বা অন্যায়ও নির্ধারিত হবে অর্থের মাপকাঠিতে। আর জীবনের সফলতা বা ব্যর্থতা তো অতি অবশ্যই। কিন্তু একজন মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ—এই পুরো যাত্রাপথের ডেবিট-ক্রেডিটের হিসাব শুধুই কি একটা এক্সেল শিট? নাকি এমন কিছুও থাকা উচিত, যা কেবল বস্তুবাদী ভাবনায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়? একটু ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status