|
ঘোষিত কিছু প্রার্থীর কর্মকাণ্ডে বিব্রত বিএনপি, একাধিক আসনে পরিবর্তনের প্রস্তুতি
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() ঘোষিত কিছু প্রার্থীর কর্মকাণ্ডে বিব্রত বিএনপি, একাধিক আসনে পরিবর্তনের প্রস্তুতি দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক-রেলপথ অবরোধ, এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপির নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয়সহ চেয়ারপার্সনের গুলশান বাসভবনের সামনেও বিক্ষোভ হয়েছে কয়েক স্থানে। বহু বিদ্রোহী নেতা তারেক রহমানের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু বিএনপির গুলশান কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা যাচাইয়ের অংশ হিসেবে ঘোষিত প্রার্থীদের নিয়ে নিরপেক্ষ ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান দিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজে বহু বিদ্রোহী ও মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ভবিষ্যৎ মূল্যায়নের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। একইসঙ্গে কিছু আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের ইঙ্গিতও মিলেছে। যদিও শীর্ষ নেতারা বলছেন, সংখ্যা খুব বেশি হবে না। মনোনয়ন বঞ্চিত দিনাজপুরের এক নেতা বলেন, আমার এলাকায় যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তিনি দেড় যুগ রাজপথের কোনো আন্দোলনে ছিলেন না। এমনকি দলের স্থানীয় কোনো কর্মসূচিতেও তাকে পাওয়া যায়নি। আমি বিশ্বাস করি, ত্যাগীদের মূল্যায়ন করে তারেক রহমান বিতর্কিতদের বাদ দেবেন। শীর্ষ নেতাদের প্রতিক্রিয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের চেয়ারম্যান অত্যন্ত বিচক্ষণ। তিনি প্রতিটি জেলা-উপজেলার নেতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন। সবাইকে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব নয়, তবে মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদেরও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অল্প কিছু মান-অভিমান স্বাভাবিক। সময়মতো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সবাই ধানের শীষকে জয়যুক্ত করতে একসঙ্গে কাজ করবে। যেসব আসনে তীব্র ক্ষোভ দলটির বিভিন্ন জেলা থেকেও উঠে আসছে নানাবিধ অভিযোগ। কয়েকটি আলোচিত আসনের অভিযোগ তুলে ধরা হলো— সিলেট-৬ এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া ইমরান আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতারা এলাকামুখী না হওয়া, দলীয় সংযোগহীনতা এবং একটি অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ক্ষুব্ধ। তাদের দাবি—নিরপেক্ষ তদন্ত করে মনোনয়ন পরিবর্তন করতে হবে। জয়পুরহাট-২ এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক আমলা আব্দুল বারী। পাঁচ মাস আগে রাজনীতিতে আসা এই প্রার্থীর জনসম্পৃক্ততা নেই বলে স্থানীয় নেতাদের দাবি। নারায়ণগঞ্জ-৩ মনোনীত প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ৫ আগস্টের পর থেকেই দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। যা গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ এ আসনে মনোনীত প্রার্থীর বয়স নব্বই উর্ধ্ব। স্মৃতিশক্তি দুর্বলতা ও অস্পষ্ট বক্তব্য নিয়ে তৃণমূল প্রশ্ন তুলেছে। এক সভায় ‘সমাবেশ’কে ‘সহবাস’ বলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি—ত্যাগী নেতা কবীর আহমেদ ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দিতে হবে। মাদারীপুর-১ কামাল-জামান নুরুদ্দিন মোল্লা মনোনয়ন পেলেও সেটি হঠাৎ স্থগিত করা হয়। তিনি দেড় যুগ ধরে এলাকায় ও ঢাকার রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। মনোনয়ন স্থগিত হওয়ায় তৃণমূল নেতারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নাটোর-১ এ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ফারজানা শারমিন পুতুলকে। কিন্তু তৃণমূলে অধিক জনপ্রিয়তা রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর। তার মনোনয়নের দাবিতে ব্যাপক শোডাউন চলছে। বরিশাল-২ মনোনীত প্রার্থী ২০১৮ নির্বাচনের পর দেশ ছেড়ে যান এবং ২০২৩ সালের আগস্টে দেশে ফিরেছেন। তার একাধিক বেফাঁস মন্তব্য ভাইরাল হয়েছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা—এসব বিতর্ক ভোটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নরসিংদী-৪ এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুল। তৃণমূল নেতারা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের আন্দোলন-সংগ্রামের অবদান মূল্যায়নের দাবি জানাচ্ছেন। মুন্সীগঞ্জ-২ এ আসনে মনোনীত প্রার্থী পূর্বে দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই। তৃণমূল নেতারা দাবি করছেন—অ্যাডভোকেট সালাম আজাদ দীর্ঘদিন সংগঠন গড়ে তুলেছেন, তাকেই মূল্যায়ন করা উচিত। টাঙ্গাইল-৩ মনোনীত প্রার্থী এ এলাকার বাসিন্দা না হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তাদের মতে, মাইনুল ইসলাম ও সাবেক মন্ত্রী লুৎফর রহমান আজাদের এলাকায় জনপ্রিয়তা বেশি। কুষ্টিয়া-১ এখানে রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লাকে প্রার্থী করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ‘সংস্কারপন্থি’ পরিচয়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এই ধরনের অসন্তোষ দেখা দিয়েছে আরও অন্তত ৫০টির বেশি আসনে—যেমন চাঁদপুর-৪, সুনামগঞ্জ-১, গাইবান্ধা-৪, জামালপুর-২, টাঙ্গাইল-১, কিশোরগঞ্জ-৫, কুড়িগ্রাম-১ ও ৩, রাজশাহী-১, ৩ ও ৪, নওগাঁ-১, ৩ ও ৪, পাবনা-৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫সহ বহু আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। দলীয় আলোচনায়ও এসব আসনের বিষয়ে পুনর্বিবেচনার গুঞ্জন রয়েছে। মনোনয়ন বঞ্চিত ডাকসাইটের নেতারা বিএনপির রাজনীতিতে আলোচিত বহু নেতা এবার মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন— * স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান * ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু * চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল * সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী * যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল * লায়ন আসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৪) * ড. এনামুল হক চৌধুরী (সিলেট-৬) * নিলোফার চৌধুরী মনি (জামালপুর-৫) * সুলতান সালাউদ্দিন টুকু (টাঙ্গাইল-৫) * তাইফুল ইসলাম টিপু (নাটোর-১) * অ্যাডভোকেট সালাম আজাদ (মুন্সীগঞ্জ-২) * ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম (ঢাকা-১০) * মো. মুনির হোসেন (পটুয়াখালী-২) * এবং আরও অনেক অভিজ্ঞ নেতা। এদের অনেকেই দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন, যা বিবেচনায় না নেওয়া নিয়ে তৃণমূলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিএনপির ভেতরে ‘পুনর্বিবেচনা’ প্রক্রিয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, “ঘোষিত তালিকায় স্পষ্ট উল্লেখ ছিল—প্রয়োজন হলে অধিকতর বিশ্লেষণ করে কিছু ক্ষেত্রে পুনর্বিবেচনা করা হবে। আমরা সেই প্রক্রিয়ারই অপেক্ষায় আছি।” দলীয় সূত্রের দাবি, ভেতরে ভেতরে ইতোমধ্যে কিছু আসন নিয়ে নতুনভাবে ভাবা হচ্ছে। বিদ্রোহ দমন ও তৃণমূলকে সন্তুষ্ট রাখতে জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে পারে হাইকমান্ড। উল্লেখ্য: বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর দেখা দেওয়া ব্যাপক অসন্তোষ ও বিদ্রোহ দলটির জন্য যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ—তা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। হাইকমান্ডের কৌশলগত সিদ্ধান্ত, পুনর্মূল্যায়ন ও তৃণমূলের ক্ষোভ প্রশমনের ওপরই এখন নির্ভর করছে দলটির সামগ্রিক নির্বাচনী সমীকরণ। শেষ পর্যন্ত কতটি আসনে পরিবর্তন আসে এবং বিদ্রোহ কতটা থামানো যায়—তার ওপরই বিএনপি নেতৃত্বের কৌশলগত দক্ষতার বড় পরীক্ষা হয়ে উঠতে যাচ্ছে আগামী দিনগুলো। |
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
