‘আত্মার পর্বত’ মানাসলু আরোহণে অদম্য বাবর
নতুন সময় প্রতিনিধি
|
![]() ‘আত্মার পর্বত’ মানাসলু আরোহণে অদম্য বাবর পর্বতটির তুষার ধস, বিপজ্জনক ঢাল, আবহাওয়ার খামখেয়ালি আর পবর্তা আরোহণের ক্লান্তি মিলিয়ে যেকোনো সময় ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে মানাসলুর শীর্ষ ছোঁয়ার যাত্রা। কিন্তু এভারেস্ট, লোৎসে, অন্নপূর্ণা-১ আর আমা দাবালাম জয়ী বাবর আলী এমন অনায়াসে দুর্গম যাত্রার কথা বলেন, যেন এইমাত্র চেনা কোনো পথে খানিকটা হেঁটে এলেন। তাইতো আট হাজারি মানাসলু যাত্রায় ‘ফুসফুস কেমন আচরণ করে’ তা দেখতে এবার অক্সিজেন ছাড়াই ওঠার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবর। একের পর এক আট হাজারি পর্বত জয়ী বাবর আলীকে অবশ্য এমনটাই মানায়। শুক্রবার ভোরে মানাসলু জয়ের পর বিকালে নেমে এসেছেন বেইস ক্যাম্পে। কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই কেন সামিট করলেন, এমন প্রশ্নে বাবর আলী বলেন, “এটা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। অতি উচ্চতায় আমার সমতলের ফুসফুস কেমন আচরণ করে, সেটা জানার একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে আমার ছিল। আর সব সময় দেখতাম এমন সব এক্সট্রিম কাজকর্মে বিদেশিরা এগিয়ে থাকে। “হিমালয়ের এত কাছে বসবাস করে এই স্পোর্টসে আমাদের সেভাবে কন্ট্রিবিউশন নেই। বলতে গেলে এই পুরো দেশটা তো হিমালয়ের দান। এসব স্পোর্টস যে আমরাও পারি, সেটাও জানান দেওয়ার ইচ্ছে মনের কোণে তো ছিলই।” তার আগে শুক্রবার বিকালে বাবর আলীর নিজের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় হাসিমুখে বাবর আলী বলেন, “আমি এই মুহূর্তে আছি বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম পর্বত মানাসলুর বেইস ক্যাম্পে। আজ সকাল ৪টা ৩৫ মিনিটে আমি মানাসলু চূড়ায় আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছি।” পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী বলেন, “এটি আমার চতুর্থ আট হাজার মিটার পর্বত অভিযান। আর প্রথম অক্সিজেন ছাড়া সামিট। গ্যাসপিং অব এয়ার (বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করা)- এই জিনিসটা আগে রোগীদের ক্ষেত্রে ফিল করেছি। আজ আমি নিজে ফিল করেছি। সবাই আমার জন্য দোয়া এবং আশীর্বাদ করবেন, যেন বাকি যে মাউন্টেনগুলো আছে, সেগুলো আমি ক্লাইম্ব করতে পারি।” যখন দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এমন বার্তা দিচ্ছিলেন, তখন বাবর আলীর পেছনে কুয়াশা মোড়ানো আকাশ আর দুর্গম পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। এই যাত্রায় বাবরের সঙ্গী তানভীর আহমেদ সন্ধ্যায় আরেক ভিডিও বার্তায় বলেন, “আজ আমার সুযোগ হয়েছে, বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত মানাসলু শিখরে বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাঁড়ানোর। এটা আমার প্রথম আট হাজারি পর্বত। “সকাল ৩টা ৩০ এ আমি পর্বতের শিখর স্পর্শ করি এবং ৫টা ৫০ এ বেসক্যাম্পে নেমে আসতে সক্ষম হই। যারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের সবাইকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভেচ্ছা।” মাউন্টেন অব দ্য স্পিরিট নেপাল ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য মতে, মানাসলু পর্বত উত্তর নেপালের গোর্খা এবং মানাং জেলার সীমান্তে অবস্থিত। হিমালয়ের অন্নপূর্ণা পর্বতমালা থেকে ৬৪ কিলোমিটার পূর্বে এর অবস্থান। মানাসলু শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘মানস’ শব্দ থেকে। মানস মানে ‘আত্মা’ বা ‘মন’। আর মানাসলু হলো ‘আত্মার পর্বত’। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস, এই পর্বত দেবতার বাসস্থান। বিশ্বে যে ১৪টি আট হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত শৃঙ্গ আছে, তার মধ্যে ১২টিই প্রথমবার জয় করেছিলেন পশ্চিমা পর্বতারোহীরা। মাত্র দুটি পর্বতের চূড়ায় প্রথম উড়েছিল এশীয় কোনো দেশের পতাকা। এরমধ্যে একটি চীনে অবস্থিত মাউন্ট শিশা পাংমা। আর অন্যটি নেপালের মানাসলু। শিশা পাংমা জয় করেছিলেন চীনারা আর মানাসলু জাপানি আরোহীরা। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী এইচডব্লিউ টিলম্যান অন্নপূর্ণা পর্বতমালার জরিপের সময় প্রথম মানাসলুকে শনাক্ত করেছিলেন। যদিও তারা আরোহণের চেষ্টা করেননি। ১৯৫৩ সালে প্রথম ৮ হাজার ১৬৩ মিটার এই পর্বত আরোহণের চেষ্টা করে জাপানি অভিযান দল। ৭ হাজার ৭৫০ মিটার পর্যন্ত উঠে তাদের ফিরে আসতে হয়। ১৯৫৪ সালে আরেকটি জাপানি অভিযাত্রী দল অভিযানে যায়। কিন্তু স্থানীয় সাম ভ্যালির বাসিন্দারা তাদের পবর্তে যেতে দেয়নি। স্থানীয়দের বিশ্বাস ছিল, পবিত্র এই পর্বত আরোহণ তাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। পরে ১৯৫৬ সালের ৯ মে তোশি ইমানিশি এবং গ্যালজেন নরবু প্রথম মানাসলুর চূড়ায় পৌঁছান। তাদের অনুসরণ করে ওই দলেরই অন্য দুই সদস্য কিচিরো কাতো ও মিনোরু হিগেতা দুদিন পর মানাসলু শীর্ষে আরোহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল প্রথম কোনো নেপালি হিসেবে উরকিয়েন শেরিং শেরপা মানাসলু জয় করেন। ‘ডেথ জোনে’ নতুন কিছু পাহাড়কে নিজের দ্বিতীয় বাড়ি বানিয়ে ফেলা বাবর যতই অনায়াসে বর্ণনা দিক না কেন, মানাসলুর কুখ্যাতি আছে বেশ। মৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় মানাসলু পরিচিতি পায় ‘কিলার মাউন্টেন’ নামেও। ১৯৭২ সালে একটি পর্বতারোহী দলের ১৫ সদস্য তুষার ধসে মারা যান। তাদের মধ্যে কোরিয়ান, জাপানি ও নেপালী পবর্তারোহী ছিলেন। ২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি তুষার ধসে মারা যান ১০ পর্বতারোহী। মানাসলু আরোহনে সাফল্যের হার ৬০ শতাংশ। তবে বেশি সফলতা মেলে শরৎকালে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে। এখন পর্যন্ত ৮৯ জন পর্বতারোহী প্রাণ হারিয়েছেন মানাসলু আরোহণে গিয়ে। সফল হয়েছেন ২ হাজার ১৭২ জন। ঝুঁকি কমাতে গত কয়েক বছর ধরে শরৎকালকেই আরোহণের সময় হিসেবে বেছে নেন আরোহী। কিন্তু সফলদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই অতিরিক্ত অক্সিজেন ব্যবহার করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। এখানেই ব্যতিক্রম বাবর আলী। কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই তিনি পৌঁছেছেন ‘কিলার মাউন্টেন’ চূড়ায়; উড়িয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা। বাবরের সঙ্গে আরেক বাংলাদেশি তানভীর আহমেদও শুক্রবার মানসলু জয় করেন। এ বিষয়ে বাবর আলী বলেন, “মানাসলুকে আগে বলা হতো কিলার মাউন্টেন। সে সময়ে আসলে অভিযান হতো প্রি-মনসুন বা বসন্তে। পরবর্তীতে দেখা গেল, এই পর্বতের আবহাওয়া বসন্তের তুলনায় শরতে ভালো থাকে। অভিযানগুলো শরতে শুরু করায় এ পর্বতে প্রাণহানি কমেছে। “প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার দিক থেকে বললে আট হাজার মিটার পর্বতগুলোতে উচ্চতা সব সময় একটা বড় বিষয়। এই উচ্চতাকে ডেথ জোন বলে। শরীরে নতুন কোষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে পুরনো কোষ মরতে থাকে। এছাড়া অত্যধিক ঠান্ডার সঙ্গে যুঝতে হয়। এই অতি উচ্চতা এবং নিম্ন তাপমাত্রার সঙ্গেই মূলত পর্বতারোহীদের খাপ খাইয়ে নিতে হয়।” এই দুই পবর্তারোহী ক্লাইম্বিং রুট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নর্থ-ইস্ট ফেস। তারা নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে শুরু করেন অভিযান। এরপর একে একে বেসিশহর, তিলচে, ভীমথাং, ধর্মশালা ও সামাগাঁও হয়ে বেসক্যাম্পে পৌঁছান। এটিই মানাসলুর ‘স্ট্যান্ডার্ড রুট’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৫৬ সালে এই রুট ধরেই প্রথম ‘পবিত্র’ পবর্তে আরোহণ করেছিলেন তোশি ইমানিশি এবং গ্যালজেন নরবু। মানাসলুর বিপজ্জনক ঢাল আর পবর্তারোহণের ক্লান্তি যেকোন সময় বিপদ ডেকে আনতে পারে। এছাড়া আছে যেকোনো সময় তুষার ধসের ভয়ও। এমন পরিস্থিতিতে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া আরোহণ শুধু শারীরিক সক্ষমতা নয়, পর্বতারোহণে অনন্য দক্ষতা অর্জনেরও একটা বড় প্রমাণ। |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |