সংসদ ছাড়াই সংবিধান সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোতে মতপার্থক্য প্রকাশ্যে
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
সংবিধান সংস্কার ইস্যুতে অন্তুর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর আবারও মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জাতীয় সংসদ ছাড়াই সংবিধান সংস্কার করতে অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার আছে কি না প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। অনেকে মনে করেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে পরিণত হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনও প্রয়োজন। কিন্তু সেই আন্দোলনের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগই নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করার পক্ষে। তাদের ভাষ্য, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যেই সংস্কার প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করার জন্য কাজ শুরু করেছে। গত রোববার জাতীয় সংসদের এলডি হলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জানান, এই সরকারই (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) সংবিধান সংস্কার করবে। তিনি বলেন, যেদিন অভ্যুত্থানের এক দফা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেদিনই সংবিধানের প্রশ্নটা বাতিল হয়ে গেছে। সেখানে বলা হয়েছিল, পুরনো রাজনীতির সেটলমেন্ট খারিজ করছি। আমরা নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত চাই। নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত মানে নতুন সংবিধান। ওইটা শুনেই বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল। সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জনগণ, রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও আন্দোলনে প্রাণ দেওয়া মানুষের পক্ষের বক্তব্য শুনে তারা ঠিক করবেন সংবিধানের কোন কোন দিকে তারা দৃষ্টি দিবেন। সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত গ্রহণ করছে কমিশন। আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই ওয়েবসাইটে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তি বা সংগঠন পরামর্শ, মতামত ও প্রস্তাব জানাতে পারবেন। দলগুলো যা বলছে মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা আব্বাস অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, সংবিধান সংশোধন করার আপনারা কে? পার্লামেন্ট ছাড়াই সংবিধান সংশোধন করে ফেলবেন? মনে রাখতে হবে, সংবিধান কোনো রাফ খাতা নয় যে যা খুশি তা-ই করবেন। সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখন করতে হলে যারা স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছেন, যারা স্টেকহোল্ডার রয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তা করতে হবে। মির্জা আব্বাস আরো বলেন, জাতিকে অন্ধকারে রেখে আপনারা যা খুশি তাই করবেন, আমরা তো সেটা মেনে নিতে পারব না। সুতরাং জাতিকে ধোঁয়াশায় রাখবেন না। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গত ১৬ বছরের বিনা ভোটের সরকারকে মানেনি, এখন এই সরকারকেও দীর্ঘদিন মানবে না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সংবিধান নিয়ে নানা মানুষের নানা মত থাকতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এটা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধান। এই সংবিধানের যে মৌল নীতি আছে তা অক্ষুণ্ন রেখে এর অপূর্ণতা দূর করতে হবে। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নে কিছু অপূর্ণতা ছিল, এ বিষয়ে ওই সময় আমাদের পার্টি তৎকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তারপর অনেকবার সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে, বিভিন্ন সময় শাসকরা সংবিধান কাটাছেঁড়া করেছে। এতে অনেক কালাকানুন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সংবিধান সংশোধন করা দরকার বলে আমরা মনে করি। কিন্তু এই কাজটা নির্বাচিত সরকারকেই করতে হবে। নির্বাচিত সরকারকে সংবিধান নির্দেশিত পথ ধরেই তা করতে হবে। সংবিধান পরিবর্তন বা বাতিল করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয় বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক। তিনি বলেন, সংবিধান নিয়ে নানাভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। সংবিধান সংশোধন হতে পারে, কিন্তু সেটা জাতীয় সংসদ করবে। তবে এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রয়োজনীয় প্রস্তাব বা সুপারিশ করতে পারে। তাদেরকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। আগামী দিনে যারাই সরকার গঠন করুক, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গত ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সংস্কার আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১০ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে। দলটির অন্যতম প্রস্তাব, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করা। বিষয়টি সংবিধানসংশ্লিষ্ট। ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। মঙ্গলবার এ বিষয়ে দলটির মুখপাত্র কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা সংবিধান বাতিল বা পুনর্লিখনের পক্ষে না। তবে একেবারেই সংস্কার না হলে ৫ আগস্টের বিপ্লব ব্যর্থ হবে। সংবিধান নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা গত সোমবার সংবিধান দিবস উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টের বার অডিটরিয়ামে এক আলোচনায় সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, কোনো ব্যক্তির কলমের খোঁচা দিয়ে সংবিধান বদলানো যাবে না। একজন ব্যক্তি যদি মনে করেন, প্রেসিডেন্টও যদি মনে করেন যে এটা ভুল, এটা তাঁরও উচিত হবে না যে কলমের খোঁচা দিয়ে এটাকে পরিবর্তন করা। জনগণের মতামতও জানতে হবে। যখন দেখা যাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার মত গড়ে উঠেছে, তখন সংবিধানে হাত দেওয়া যেতে পারে। সংবিধানের যে পবিত্রতার কথা আমরা বলি, মৌলিক আইনের যে কথা আমরা বলি, সব আইনের ঊর্ধ্বে সংবিধান। তাই যেনতেনভাবে এটাতে হাত দেওয়া যায় না। আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশ্লেষক ড. শাহদীন মালিক বলেন, দেশ ও রাষ্ট্র চালাতে গেলে সব সরকারেরই সমস্যা হয়। কিন্তু সমস্যায় পড়লেই আমরা সমাধান খুঁজি সংবিধান সংশোধন করে সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের। এটা পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সংবিধান নিয়ে যে বিতর্ক আসছে, তা আমাদের সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি নির্বাচনের জন্য কালো মেঘ দেখছি। এখন সংবিধানে কিছু করলে অ্যাপ্রুভ করবে কে? এসব আলোচনা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করলে তা টেকে না। সংস্কার কমিশন যা বলেছে গত রোববার সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, সংবিধান সংশোধন, পুনর্বিন্যাস, নাকি পুনর্লিখন হবে তা রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও প্রস্তাব নেওয়া হবে লিখিতভাবে। সংস্কার কমিশন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। পতিত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ এবং জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ও সমর্থনকারীদের সুপারিশ নেবে না কমিশন। ড. আলী রীয়াজ তার লিখিত বক্তব্যে সাংবিধানিক সংস্কারের সাতটি উদ্দেশ্যের কথা জানান। এর অন্যতম হচ্ছে দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা। |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |