|
যেভাবে রক্ষা পেল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() যেভাবে রক্ষা পেল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড এই ভাষণটির আরেকটি অনন্য দিক হলো, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ রেকর্ডেড ভাষণ। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি জান্তা। কিন্তু গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ মধ্যরাত; অর্থাৎ, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জাতির পিতা। ৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা দেওয়াই ছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর চূড়ান্ত বিজয়ের পথে শুরু হয় বাঙালির রক্তাক্ত সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণটি হয়তো স্মৃতির গর্ভে হারিয়েই যেত। কিন্তু তা হতে দেননি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সাত বাঙালি কর্মকর্তা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ভাষণের টেপ রক্ষা করেন তাঁরা। এই বাঙালি কর্মকর্তারাই ভাষণটির ভিডিওচিত্র ধারণ করেছিলেন। এটিকে ডেভেলপের পর সংরক্ষণও করেছিলেন তাঁরা। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: জাতির পিতার ভাষণটি ছিল সময়োপযোগী ঘোষণা ও সঠিক দিকনির্দেশনাঐতিহাসিক ৭ মার্চ: জাতির পিতার ভাষণটি ছিল সময়োপযোগী ঘোষণা ও সঠিক দিকনির্দেশনা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সাবেক ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার। ২০২১ সালে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সেই সাক্ষাতে তিনি জানিয়েছিলেন, কীভাবে ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিওটেপ তাঁরা সরিয়ে নিয়েছিলেন। ভাষণ ধারণে জন্য ৭ মার্চের কয়েকদিন আগে থেকেই চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ফিল্ম ডিভিশনের তৎকালীন পরিচালক আবুল খায়েরের নেতৃত্বে তাঁরা প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই দলটিতে ছিলেন ক্যামেরাম্যান ছিলেন জি জেড এম এ মবিন, এম এ রউফ, সহকারী ক্যামেরাম্যান আমজাদ আলী খন্দকার, এস এম তৌহিদ, আর সৈয়দ মইনুল আহসান। এ ছাড়া দুজন লাইটবয় জুনায়েদ আহমেদ ও হাবিবও ছিলেন এই দলে। আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ‘সেদিন মঞ্চে ক্যামেরার দায়িত্বে ছিলেন জি জেড এম এ মবিন সাহেব। আর তাঁর সহকারী হিসেবে ছিলাম আমি। এ এ রউফ সাহেব, আর এম এম তৌহিদের দায়িত্ব ছিল ঘুরে ঘুরে ভিডিওচিত্র নেওয়ার। আর সৈয়দ মইনুল আহসান ছিলেন সাউন্ড রেকর্ডের কাজে।’ সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সাউন্ডপ্রুফ ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড হয়েছিল জানিয়ে ৭ মার্চের ভাষণের মুহূর্ত বর্ননা করেন আমজাদ আলী। তিনি বলেন, ‘একটা গুজবও ছিল যে, বোমা মেরে সব উড়িয়ে দেবে। প্রস্তুতিও নাকি ছিল। আমরা তো তখন ভয় পেয়েছি। এই যে সাতজনের নাম বললাম, আমরাই প্রথম প্রকাশ্যে মাঠে এসেছি। আর কেউ কিন্তু আসেনি। তখন আমরা পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী। গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা উপস্থিত ছিল। তারা আমাদের দেখেছে যে, আমরা কাজ করছি। ভয় ছিল, ধরে নিয়ে যাবে। তবে সাহস ছিল, বঙ্গবন্ধু আমাদের যেভাবেই হোক বের করে নিয়ে আসবে। আটকে রাখতে পারবে না। আর মরে গেলে তো মরেই গেলাম।’ মুক্তিকামী বাঙালিদের বীরত্বে রক্ষা পেয়েছিল ইতিহাসের অমূল্য ভাষণমুক্তিকামী বাঙালিদের বীরত্বে রক্ষা পেয়েছিল ইতিহাসের অমূল্য ভাষণ সেদিন সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দান ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। জনতার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বীরের বেশে মঞ্চে এলেন। সকলেই তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধু কী বলেন, তা শুনতে। আমজাদ আলী বলেন, ‘আশপাশে যারা ছিল, কারও সাথে কোনো কথা না বলে বঙ্গবন্ধু সরাসরি ডায়াসে এসে চশমা রেখে ভাষণ শুরু করলেন। একটানা বলে গেলেন। কারও কোনো স্লিপও নিলেন না, কারও কোনো ইশারাও শুনলেন না। কী বলবেন, আগে থেকে কোনো কিছু ঠিকও করা ছিল না। যা বললেন, তা তো রেকর্ডে আছেই, আপনারা শুনেছেন। তখন পাকিস্তান আমল। তার মধ্যেও তিনি বললেন স্বাধীনতার কথা।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করার পর বাঙালি কর্মকর্তারা ফিল্মগুলো নিয়ে এলেন সচিবালয়ের ২২ নম্বর শেডে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের কার্যালয়ে। কিন্তু সে সময় তাঁরা পড়লেন আরেক সংকটে। ফিল্ম ডেভেলপ করার সময় কী নামে করা হবে, তা নিয়ে। অবশ্য সে উপায়ও বের করে ফেলেন তাঁরা। আমজাদ আলী বলেন, ‘তখন ডেভেলপ করতে হতো এফডিসিতে। এফডিসিতে গেলাম। কিন্তু ফিল্মের উপরে লিখব কী? সে বছর একটা সাইক্লোন হয়েছিল। তো একটা ফিল্মের উপর লিখলাম, “সাইক্লোন”। অন্যগুলোর কোনোটাতে “নির্বাচন”। এভাবে লিখে “এক”, “দুই” দিয়ে আমরা ডেভেলপে দিতাম। তারপর সেগুলোর রক্ষণও আমরাই করতাম। পরিচালকের একটা আলমারি ছিল। সেখানে সারিবদ্ধভাবে রাখা হতো। আমরা এভাবেই ফিল্ম প্রসেস করে নিয়ে আসলাম।’ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: বাঙালি জাতির মুক্তির আখ্যানঐতিহাসিক ৭ মার্চ: বাঙালি জাতির মুক্তির আখ্যান ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর রাতেই দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয় পাক সেনাবাহিনী। এ সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি তারা নষ্ট করে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে সেই বাঙালি কর্মকর্তারা নামলেন নতুন এক লড়াইয়ে—বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভিডিও টেপ রক্ষার লড়াই। ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। সচিবালয়েও বেড়ে যায় সেনাবাহিনীর আনাগোনা। এ পরিস্থিতিতে একদিন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের আমজাদ আলীকে ডেকে বলেন, ‘আমজাদ, তোমাকে একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং সেটা এই মুহূর্তে এবং আজই।’ আমজাদ জবাবে বলেন, ‘কী করতে হবে স্যার?’ আবুল খায়ের বলেন, ‘তুমি এখনই সদরঘাট যাও। সদরঘাট থেকে একটা ট্রাংক নিয়ে এসো।’ আমজাদ আবুল খায়েরের কথামতো সদরঘাট থেকে একটি ৪২ ইঞ্চির কালো ট্রাংক নিয়ে এলেন। সেই ট্রাংকেই ভরা হলো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের ফিল্মগুলো। সাথে রাখা হয়েছিলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। ট্রাংকটিতে বঙ্গবন্ধুর আরও কিছু ছবি ভরা হলো। আবুল খায়ের আমজাদকে এ সময় বলেন, ‘তোমাকে আজই বের হয়ে যেতে হবে, জয়পাড়ার উদ্দেশ্যে।’ আবুল খায়েরের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমজাদ বললেন, ‘স্যার আমার বাবার সাথে একটু দেখা করে আসি।’ অনুমতির সঙ্গে সঙ্গে আমজাদের হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দিলেন আবুল খায়ের। পরে বাবাকে বিদায় দিয়ে আবারও সচিবালয়ে ফিরে এলেন আমজাদ। এ সময় আমজাদকে একটি রুমে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাত ধরে আবুল খায়ের বললেন, ‘আমজাদ! আল্লাহ হাফেজ!’ আবুল খায়ের জানতেন, আমজাদ যদি ধরা পড়েন, তাহলে তিনি হয়তো আর ফিরে আসবেন না। সারা শহরই তখন সেনাবাহিনীর নজরদারিতে। তাই কীভাবে সচিবালয় থেকে বের হবেন, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলেন আমজাদ। কিন্তু এখানেও রক্ষাকর্তা হয়ে এগিয়ে এলেন এক বাঙালি সার্জেন্ট। ফরিদ নামের এই সার্জেন্টের সহযোগিতায় সচিবালয় থেকে পাস ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর ভাষণভর্তি ট্রাংক নিয়ে বের হন আমজাদ। আমজাদ বলেন, ‘দ্বিতীয় গেট দিয়ে তখন শুধু ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। ফরিদ করল কী, পল্টন থেকে যে গাড়িগুলো আসছিল, ওগুলোকে আটকে দিয়ে আমাকেসহ বেবি ট্যাক্সি বের করে দিল। আমার সাথে যারা চাকরি করত, অনেককেই বললাম, আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়। কিন্তু কেউ আসল না। আমি একাই আল্লাহর নাম নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বেবিওয়ালাও বুঝল, এটা মনে হয় বিশেষ ব্যবস্থা। সে-ও কোনো দিকে না তাকিয়ে দিল এক টান।’ একপর্যায়ে প্রেস ক্লাব, কার্জন হল, চানখাঁর পুলের সামনে দিয়ে চকবাজার হয়ে সোয়ারি ঘাট পৌঁছালেন আমজাদ। সেখানে যাওয়ার পর দুটো ছেলে এগিয়ে এলো ট্রাংক নিতে। আমজাদ বললেন, ‘তোমরা পারবা না। বড় কাউকে ডাকো।’ পরে একজন এসে ট্রাংক নিয়েই বলে উঠল, ‘ইসমে কেয়া হ্যায় ইতনা ওজন।’ আমজাদ বললাম, ‘নিয়ে যা, কোনো কথা কইস না। আমাকে পার করে দে আগে।’ জিঞ্জিরা পৌঁছানোর পথে কয়েক শ মানুষকে জীবন নিয়ে পালাতে দেখেন আমজাদ। তিনি বলেন, ‘বোঝেন না, জীবনের ভয়ে ওরা পালায়, আর আমি ছুটছি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঁচাতে।’ আমজাদ আলী সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে আরও বলেন, ‘দেখলাম একটা বাস ছেড়ে দিচ্ছে। আমি সেটার পেছনে জোরে এক থাপ্পড় দিলাম। তখন তরুণ ছিলাম, চেহারার মধ্যে একটা অন্য রকম ইয়ে ছিল। ড্রাইভার পেছনে তাকিয়ে বাস থামিয়ে দিল। আমাকে ইঙ্গিত দিল উপরে তুলে দেন। আমি বাসের ছাদে উঠে পড়লাম। তারপরও কিন্তু শান্তি পেলাম না। ভয় হলো যদি আমার পিছু নেয়, যদি দেখে ফেলে তাহলে কী হবে?’ জিঞ্জিরা থেকে আমজাদ ছুটলেন বক্সনগর এলাকার দিকে। সেখান থেকে ঘোড়ায় করে গেলেন দোহারের জয়পাড়া মজিদ দারোগার বাড়ি। সেখান গিয়ে আমজাদ পেলেন আবুল খায়েরকে। আমজাদের ভাষায়, ‘খায়ের সাহেব তো আমাকে বিদায়ের সাথে সাথে বের হয়ে আমাকে পায়নি। এত জলদি যে আমি বের হয়ে যাব, এটা উনি চিন্তা করেননি। আমাকে না পেয়ে আবার তিনি গেছেন পাগল হয়ে। তিনি মনে করেছেন, আমাকে মনে হয় ধরে নিয়ে গেছে, মেরে ফেলেছে। আমার যে বাড়িতে যাওয়ার কথা, তিনিও সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। এদিকে আমিও পৌঁছেছি। আমি তো ওখানে গিয়ে বলিনি, বলেছি অফিসের কাগজপত্র। এটার মধ্যে কী আছে, এত কিছু বলিনি।’ সেই রাত জয়পাড়া মজিদ দারোগার বাড়িতেই থাকলেন আবুল খায়ের ও আমজাদ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের রেকর্ড পরবর্তী কিছুদিন মজিদ দারোগার বাড়িতেই সুরক্ষিত ছিল। পরে সেখান থেকে রেকর্ডটি নেওয়া হলো জয়পাড়ার পাশের চরকোশায়ই নামের আরেকটি গ্রামের দানেশ খাঁ ও উমেদ খাঁর বাড়িতে। আমজাদ বলেন, ‘উমেদ খাঁর ধানের গোলায় চলে গেল ওটা (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ)। খায়ের সাহেব যখন কলকাতায় চলে গেলেন, সেখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করে মুক্তিবাহিনী পাঠিয়ে ওটাকে নিয়ে যান ভারতে।’ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল ভারতে। দেশ স্বাধীনের পর আবুল খায়ের ভাষণের ফিল্মগুলো নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। https://www.itvbd.com/134848
|
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
