ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
বৃহস্পতিবার ৬ নভেম্বর ২০২৫ ২১ কার্তিক ১৪৩২
টু ফিঙ্গার টেস্ট
নারীর চরিত্র নির্ণয় দুই আঙুলে?
নতুন সময় ডেস্ক
প্রকাশ: Monday, 21 July, 2025, 3:44 PM

নারীর চরিত্র নির্ণয় দুই আঙুলে?

নারীর চরিত্র নির্ণয় দুই আঙুলে?

যে সমাজে মানুষ চাঁদে পা রেখেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে—সেই সমাজেই এখনো একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে তার যন্ত্রণার মূলে থাকে এক লজ্জাজনক ও মধ্যযুগীয় অধ্যায়, যার নাম হলো ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’। চিকিৎসার নামে এমন একটি পরীক্ষা, যেখানে ভিকটিমের সম্মান, তার শারীরিক গোপনীয়তা ও তার মনোজগতের ওপর চালানো হয় দ্বিতীয়বারের মতো চরম আঘাত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুগে এ পদ্ধতির কি কোনো বৈজ্ঞানিক, সামাজিক বা নৈতিক বৈধতা আছে?

টু ফিঙ্গার টেস্ট এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে ধর্ষণের শিকার নারীর যোনিপথে চিকিৎসক আঙুল প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেন, ‘তার পূর্ববর্তী যৌন অভিজ্ঞতা’ বা ‘তার হাইমেন অক্ষত আছে কি না’। এই তথাকথিত পরীক্ষা নির্ভর করে পুরোনো ও পুরুষতান্ত্রিক এক বিশ্বাসের ওপর, যা ধর্ষণকে শারীরিক আঘাতের প্রমাণ দিয়ে বিচার করে, মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত বা সম্মতির গুরুত্ব একেবারেই অস্বীকার করে। ভুক্তভোগীকেই কেন এ ন্যক্কারজনক অপমান করা হয়?

ধর্ষণের শিকার হওয়া এক নারীর প্রথম প্রয়োজন নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও সহানুভূতি। অথচ সেই সময় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে, যেখানে এই পরীক্ষার নামে ফের একবার তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়- তুমি নারী, তুমি ‘পবিত্র’ ছিলে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন! এই প্রথা মূলত নারীর শরীর ও তার যৌনতা নিয়ে একটি পুরোনো কুসংস্কারের ধারক। ধর্ষণের জন্য দায়ী যে পুরুষ, তাকে নিয়ে প্রশ্ন নয়, উল্টো নির্যাতিতা নারীর ওপরই পড়ে প্রমাণের ভার!

এ বিষয়ে আদালত ও মানবাধিকার সংস্থা ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-কে অবৈধ ঘোষণা করে বলে, এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বাংলাদেশেও উচ্চ আদালত এ ধরনের পরীক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এই পরীক্ষার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো দেশের কিছু অঞ্চলে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়- আইনের অভাবে নয়, বরং সচেতনতার ঘাটতিতে, যা মানসিক সহিংসতার এক অব্যক্ত রূপ বলা যায়।

ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী কেবল শরীরিকভাবে নয়, সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়ে মানসিকভাবে। সে যখন সাহস করে ধর্ষণের ঘটনা জানাতে আসে, তখনই আমাদের সমাজের ব্যবস্থাটি তাকেই প্রথমে সন্দেহ করে, তারপর পরীক্ষা করে আর শেষে প্রশ্ন করে- ‘তুমি আগে কতবার শারীরিক সম্পর্ক করেছ?’ টু ফিঙ্গার টেস্ট তাই ধর্ষকের পর দ্বিতীয় আঘাত, যা সমাজ ও চিকিৎসক একত্রে দেয় ‘প্রথা’র নামে। এমন এক দেশে, যেখানে নারীর শরীর এখনো যৌনতার মানদণ্ডে মাপা হয়, সেখানে এই পরীক্ষার ছুঁতোয় চলে এক ধরনের মানসিক ধর্ষণ। এরকম নোংরা প্রথা আর কতদিন চলবে? নারী কি কেবল ‘হাইমেন’?

টু ফিঙ্গার টেস্ট মূলত এক ধরনের কুসংস্কারপ্রসূত পরীক্ষা, যার ভিত্তি পড়ে আছে নারীর হাইমেন বা কুমারিত্ব নিয়ে সামাজিক মোহে। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বলে, হাইমেন ছিঁড়ে যেতে পারে খেলাধুলা, সাইকেল চালানো বা অনিয়মিত মাসিকের কারণেও। অর্থাৎ ধর্ষণের প্রমাণ হাইমেন দিয়ে নয়, ঘটনাপ্রবাহ, ফরেনসিক প্রমাণ ও মানসিক অবস্থা দিয়ে হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই পুরোনো ধারণা ধরে রেখে আমরা কাদের সন্তুষ্ট করছি? নাকি আমরা এখনো নারীকে মালিকানার বস্তু হিসেবেই দেখে যাচ্ছি?

‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ মূলত এক ধরনের কুসংস্কারপ্রসূত পরীক্ষা, যার ভিত্তি পড়ে আছে নারীর হাইমেন বা কুমারিত্ব নিয়ে সামাজিক মোহে। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বলে—হাইমেন ছিঁড়ে যেতে পারে খেলাধুলা, সাইকেল চালানো বা অনিয়মিত মাসিকের কারণেও। অর্থাৎ ধর্ষণের প্রমাণ হাইমেন দিয়ে নয়, ঘটনাপ্রবাহ, ফরেনসিক প্রমাণ ও মানসিক অবস্থা দিয়ে হয়।

নারী সাক্ষ্য নয়, সম্মান চায়। যে মেয়ে ভয়, লজ্জা এবং সামাজিক অপবাদ উপেক্ষা করে থানায় বা হাসপাতালে যায়, তার কাছে টু ফিঙ্গার টেস্ট মানে এক ভীতিকর নতুন অধ্যায়। সে চায় বিচার, কিন্তু পায় অনৈতিক পরীক্ষা। সে চায় বিশ্বাস, পায় সন্দেহ। ধর্ষণের শিকার নারীকে সাক্ষ্য দিতে হয় না, তাকে সম্মান জলাঞ্জলি দিতে হয়। তার সম্মতি, তার কথা, তার অভিজ্ঞতাই হওয়া উচিত মূল প্রমাণ। পুরুষতন্ত্রের ছদ্মবেশী পদ্ধতি আর কতদিন চলবে?

টু ফিঙ্গার টেস্ট আসলে এক ধরনের ছদ্মবেশী পুরুষতন্ত্র, যা চিকিৎসার আড়ালে নারীর চরিত্র যাচাই করে। ধর্ষণ হয়েছে কি না, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়—নারী ‘শুদ্ধ’ ছিল কি না! এক ধরনের ‘victim blaming’ চালানো হয় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। অথচ কোনো পুরুষ ধর্ষণের অভিযোগ পেলে তার ‘কুমারিত্ব’ পরীক্ষা হয় না- কারণ আমাদের সমাজে চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয় একমাত্র নারীর! আসলে এদেশে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ কোথায়?

আইন আদালতে টু ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ—তবুও বাস্তবে চলছে। কেন? কারণ বেশিরভাগ থানায় কর্মরত পুলিশ, মেডিকেল স্টাফ এমনকি অনেক ডাক্তারই জানেন না এই আইন বা নির্দেশনার অস্তিত্ব। অনেকে জেনে-শুনেও পুরোনো রীতিতে কাজ চালিয়ে যান। ফলে প্রয়োজন পড়ে প্রশিক্ষণভিত্তিক পরিবর্তনের, শুধু কাগজে-কলমে নয়। এজন্য সচেতনতা জরুরি। প্রয়োজন নারীকেন্দ্রিক নীতিমালা ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা, দরকার টেকসই সমাধান।

ধর্ষণ-পরবর্তী যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত নারীর অভিজ্ঞতা, নারীর ভাষ্য এবং তার মনের অবস্থা। মনোবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, ধর্ষণের শিকারদের জন্য আলাদা কাউন্সেলিং ও সমর্থন-ব্যবস্থা থাকা জরুরি। প্রমাণের নামে ধর্ষিতা নারীর শরীর নিয়ে টানাটানি না করে, আমাদের উচিত– একজন মানুষ হিসেবে তার পাশে দাঁড়ানো।

টু ফিঙ্গার টেস্ট শুধু পদ্ধতি নয়, এটি একটি মানসিকতা—যেখানে নারীকে প্রথমেই সন্দেহ করা হয়, বিচার নয় অপবাদ দেওয়া হয়, আর সম্মান নয়, চাওয়া হয় তার দেহের হিসেব। এই মানসিকতা ভাঙতে হলে শুধু আইন নয়, দরকার সমাজের প্রতিটি স্তরে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নারী যদি সাহস করে মুখ খুলতে পারে, তাহলে সমাজেরও উচিত—তার কণ্ঠস্বর অবজ্ঞা নয়, সম্মান জানানো।

টু ফিঙ্গার টেস্টের কোনো মেডিকেল প্রয়োজন নেই। বরং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মানসিক সহায়তা, ফরেনসিক স্যাম্পল (যেমন- সিমেন, ডিএনএ, নখের নিচের আঁচড়) বিশ্লেষণ এবং সম্মতির ভিত্তিতে ভিডিও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এখনকার আধুনিক, বৈজ্ঞানিক ও মানবিক উপায়। সর্বোপরি, একটি মেয়ের ‘না’ মানেই না—এই নীতিকে কেন্দ্র করে বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণ হলো সম্মতির অভাব, ভালোবাসার নয়; কাজেই শারীরিক প্রমাণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত মানসিক অবস্থান এবং সম্মতির প্রশ্নকে।

যুগোপযোগী পদক্ষেপের ভিত্তিতে এ বিষয় নিয়ে মেডিকেল শিক্ষায় মানবাধিকারভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। ধর্ষণ তদন্তে নারীকেন্দ্রিক পদ্ধতির চর্চা বাড়াতে হবে। ‘রেইপ ক্রাইসিস সেন্টার’ বা ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলোর মানোন্নয়ন প্রয়োজন। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যেন ধর্ষণ মানেই টু ফিঙ্গার টেস্ট—এই বিভ্রান্তি ভেঙে যায়।

টু ফিঙ্গার টেস্ট কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নয়, এটি একটি সামাজিক লজ্জা। এটি নারীকে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করে হাসপাতালের বিছানায়। এই প্রথা যতদিন থাকবে, ততদিন ধর্ষণের শিকার নারীরা ন্যায়বিচারের বদলে ভোগ করবে অপমানের নতুন নাম। আমাদের উচিত এই মানসিকতা, এই পরীক্ষা এবং এই পুরো দৃষ্টিভঙ্গি বিদায় জানানো। কারণ, একটি সভ্য সমাজ ধর্ষণ বন্ধ করতে চায় ধর্ষককে শাস্তি দিয়ে, কিন্তু যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার, তাকে অপমান করে নয়।

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status