সামাজিক মিডিয়া এবং বাস্তব জগত গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার একটা দারুণ বিষয় পেয়েছে! বই এবং একুশে বইমেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় যথারীতি বিষয়টি আমি জেনেছিও অনেক পরে। তার উপরে পুরাণ নিয়ে লেখালেখি করি বলি এমনিতেই বিপদে আছি। এই স্পর্শকাতর বিষয়ে তাই লেখাটা আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আরো ভয়াবহ। পক্ষান্তরে নিজে একজন চিকিৎসক। তাই কিছু না বলেও থাকতে পারছি না।
এখানে প্রশ্ন দু'টি - ১) ট্রান্সজেন্ডার, হিজরা এবং সমকামিতা কি এক জিনিস? ২) সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা কি সঠিক সিদ্ধান্ত? এই দুটো প্রশ্নের আলোকেই আমি কিছু কথা খুব সংক্ষিপ্তাসারে বলতে চাই।
ট্রান্সজেন্ডার: Transgender মানেটা কী? যখন একজন জন্ম থেকেই সম্পূর্ণভাবে তার sex নির্দিষ্ট করা থাকে, অর্থাৎ সে একজন ছেলে বা মেয়ে তা নির্দিষ্ট থাকে, কিন্তু পরবর্তীতে তার চরিত্রে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের উদ্ভূত হয়, যাতে তার কাছে মনে হয় সে হয়তো ছেলেদের মতো থাকতে পছন্দ করে, তার অনুভূতি হয়তো ছেলেদের মতো (যখন sex নির্দিষ্ট থাকে যে, সে একজন মেয়ে); কিংবা ভাইস ভার্সা (বিপরীতক্রমে)। দেখুন, এখানে তার sex নির্দিষ্ট, কিন্তু sex অনুযায়ী তার gender mismatch করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি তার কোনো intentional attitude, নাকি unintentional? Medical Science এ একটি টার্ম আছে - Gender Dysphoria। বিস্তারিত আমি যাবো না, নেটে সার্চ দিলেই জানতে পারবেন সবাই। এই সমস্যাটি দেখা দেয় সাধারণত childhood থেকে শুরু করে adolescence এ, বড় হয়ে ধরা দেয় adulthood এ। কেউ ট্রিটমেন্ট করে জেন্ডার মিসম্যাচডটাকে কম্ফোর্ট জোনে নিয়ে যায়, কেউ ট্রিটমেন্ট করে সাইকোলজিকালি। এটা নিয়ে খুব বিতর্ক এখনো আছে, বিশেষ করে ধর্মের সাথে (শুধু ইসলাম নয়, প্রধান সব ধর্মেই), তবুও আমার ব্যক্তিগত ধারণা এটি রোগ নয়, আবার ইনটেনশনাল নয়। তবে, এটি একটা সমস্যা।
হিজড়া:
সাধারণভাবে হিজড়া হচ্ছে intersex। এখন প্রশ্ন হচ্ছে intersex কী? যাদের জন্মগতভাবে sex নির্দিষ্ট নয়, হোক সেটা ক্রোমোসোমাল কারণে কিংবা জন্মগত ত্রুটির কারণে, তারাই intersex। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ছেলেদেরই হয়ে থাকে। এবং তাদের এই intersex গোপন করে যদি ছেলে সন্তান হিসাবে বড় করা হয়, এক পর্যায়ে সে নিজেকে মেয়েদের মতো ভাবে। মেয়েদের মতো পোশাক পরতে চায়। এই ইন্টারসেক্সদেরই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে হিজড়া বলা হয়ে থাকে। খুব সুস্পষ্ট ব্যাপার এই যে, ট্রান্সজেন্ডারদের ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে সেক্স নির্দিষ্ট থাকলেও ইন্টারসেক্স বা হিজড়াদের ক্ষেত্রে উল্টো, তাদের সেক্স জন্মগতভাবে নির্দিষ্ট না। তাই এদেরকে third gender ও বলা হয়ে থাকে। অনেকেই হিজড়াদের ট্রান্সজেন্ডার বলে থাকেন, যা ৯৫% ভুল। ৫% ভুল নয় কেন? কারণ, ট্রান্সজেন্ডারের ক্ষেত্রে খুবই rarely ইন্টারসেক্স পাওয়া গিয়েছে, আবার intersex এর ক্ষেত্রে তার চেয়েও rarely ট্রান্সজেন্ডারের উদাহরণ আছে। তবে মোটা দাগে, ট্রান্সজেন্ডার এবং ইন্টারসেক্স বা হিজড়া আলাদা।
সমকামিতা:
এবার আসি এই বিষয়ে। Homo, hetero বা bisexual এগুলো কী? এগুলো কোনো জেন্ডার নয়, এগুলো সেক্সুয়াল এক্টিভিটির বিভিন্ন ওরিয়েন্টেশন। এখন প্রধান এবং স্বাভাবিক সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন হচ্ছে straight. যখন এর বিপরীত কিছু হয়, যেমন সমকামীতা, বা লেসবিয়ান বা বাই সেক্সুয়াল, সোজা ইংরেজিতে যাদেরকে বলা হয় LGBTQ (এখানে LGB ধরে নিবেন) এটা নিয়ে প্রায় সব প্রধান ধর্মে নিষেধাজ্ঞা আছে। এটা ধর্মীয় ব্যাপার। এমনকি পবিত্র কোরানে লুত জাতির কথা বলা হয়েছে, যারা সমকামিতায় লিপ্ত ছিল। Note it, they were neither transgender nor intersex, they were LGB! এই যে সমকামিতা বা লেসবিয়ান বা গে বা বাই, যাই বলুন না কেনো, তা একজন সাধারণ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও হতে পারেন, আবার ট্রান্সজেন্ডারও হতে পারেন, আবার হিজড়াও হতে পারেন। কারণ, এটা সেক্সুয়াল এক্টিভিটির ওরিয়েন্টেশন, জেন্ডার নয়! রিমেম্বার ইট, দিস ইজ নট জেন্ডার।
যে কারণে ট্রান্সজেন্ডার এবং থার্ড জেন্ডার (বা হিজড়া) অধিকার বা আইন একসাথে আছে, এবং সেখানে LGB এর কোনোই স্থান নেই।
এবার আসি সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে কী লিখেছে?
পাঠ্য পুস্তকে যা লিখেছে, সেখানে সম্পূর্ণভাবে, আবারো বলছি সম্পূর্ণভাবে হিজড়াদের নিয়ে বলা হয়েছে। এমনকি ট্রান্সজেন্ডারও না। অনেকেই দ্বিতীয় বাক্যের ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডারের উদাহরণ টেনেছেন। হ্যাঁ, এটি যেমন ট্রান্সজেন্ডারের একটি বৈশিষ্ট্য, তেমনি একইভাবে হিজড়াদেরও একটা খুব সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই গল্পে সমকামিতার গন্ধও আমি খুঁজে পাইনি!
আসিফ সাহেব যা বলেছেন:
আমি ওনার ভিডিয়ো শুনেছি, এরপর পাঠ্যপুস্তকের লেখা পড়েছি এবং সবশেষে চরমভাবে মর্মাহত হয়েছি, ওনি কীভাবে এতোদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে ছিলেন? ওনি জানেন না সমকামিতা কাকে বলে, জানেন না হিজড়া কাকে বলে এবং জানেন না ট্রান্সজেন্ডার কাকে বলে! ওনার ফেসবুকে পুরানো অনেক পোস্ট দেখেছি। মনে হয়েছে, ওনি জনগণের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে চেয়েছেন এবং তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। এবং এ কারণেই হিজড়া টপিকে সমকামিতা নিয়ে এসেছেন, কওমে লুত নিয়ে এসেছেন, ধর্ষন আর ধর্ষকের কথা এনেছেন। এমনকি ধর্ষণ কাকে বলে, সেটারও তিনি ভুল সংজ্ঞা দিয়েছেন। উনি ভুলে গিয়েছেন, rape এর সংজ্ঞায় নারী পুরুষ অর্থাৎ gender নেই, আছে sex, any kind of sexual intercourse or sexual penetration। এবং সবকিছুই Intentionaly ভুল বলেছেন।
এবার সবশেষ প্রশ্ন নিয়ে বলতে চাই - এই টপিক সপ্তম শ্রেণীর জন্য উপযুক্ত?
প্রথমেই বলি, আমার নিজের কাছে এটা খুব ভালো লেগেছে। শিশুদেরকে শিশুকাল থেকেই সব ধরনের মানুষ সম্পর্কে জানানো উচিত, তাদের প্রতি আমাদের আচার আচরন কী হবে তা শেখানো উচিত। তা না হলে আমার মত অবস্থা হবে, যে আমি ডাক্তার হবার পূর্ব পর্যন্ত ঢাকার বিজয় সরনির সিগনালে গাড়ি থামলে হিজড়াকে আসতে দেখলে আতংকে হিম হয়ে যেতাম! তবে, দেশের এই প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে এখনও সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, যেখানে সপ্তম শ্রেণীতে এই বিষয়ে পড়ানো যাবে। এটা খুবই সামান্য একটা বিষয় ছিল, অথচ অযাচিতভাবে সম্পূর্ণ অপ্রাসাংগিকভাবে জোর করে সমকামিতা বিষয় এনে বিতর্ক করার intentional চেষ্টা করা হয়েছে। সবশেষে বলতে চাই, আমি পুরাণ নিয়ে লিখলেও আমি প্রচন্ড রকমের আস্তিক (এবং সেটা পুরাণের জন্যই! এ বিষয়ে পরে লিখব), এবং সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, আমি straight, এবং শুধুমাত্র straight.