ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫ ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
টিকতে পারছে না বেসরকারি এয়ারলাইন্স, ব্যর্থতার দায় কার?
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Monday, 5 May, 2025, 5:45 PM
সর্বশেষ আপডেট: Monday, 5 May, 2025, 7:56 PM

টিকতে পারছে না বেসরকারি এয়ারলাইন্স, ব্যর্থতার দায় কার?

টিকতে পারছে না বেসরকারি এয়ারলাইন্স, ব্যর্থতার দায় কার?

কয়েক বছর ধরে নানামুখী চাপে থাকা বেসরকারি এয়ারলাইন্স নভোএয়ার গত ২ মে ফ্লাইট পরিচালনা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে। নভোএয়ার সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) মৌখিকভাবে দুই সপ্তাহ ফ্লাইট বন্ধ রাখার কথা জানালেও আদৌ আবার অপারেশনে ফিরতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তাদের। কারণ, বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের ইতিহাসে সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়া কোনো এয়ারলাইন্স পরে আর অপারেশনে ফিরতে পারেনি।

বেসরকারি এয়ারলাইন্স বন্ধের ঘটনা এটিই বাংলাদেশে প্রথম নয়। গত ২৬ বছরে মোট ১০টি যাত্রীবাহী এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়েছে। কোনো বেসরকারি এয়ারলাইন্সই ১৩-১৪ বছরের বেশি টিকতে পারেনি।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি এয়ারলাইন্স হিসেবে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট শুরু করে ‘অ্যারো বেঙ্গল এয়ারলাইন্স’। তবে অতিরিক্ত ল্যান্ডিং ও পার্কিং চার্জ (ওয়াইড বডি এয়ারক্রাফটের সমান) এবং ওয়েটিং চার্জ বেশি থাকায় ৪ বছরের মাথায় ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয় এয়ারলাইন্সটি।

এরপর ১৯৯৭ সালে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করা ‘এয়ার পারাবত’ বন্ধ হয় ২০০১ সালে। ২০০৭ থেকে দুই বছর ফ্লাইট পরিচালনা করে বন্ধ হয় ‘বেস্ট এয়ার’। ২০০৫ সালে চালু হয় ‘এয়ার বাংলাদেশ’ এবং ২০০৭ সালে চালু হয় ‘রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স’। অব্যাহত লোকসানের কারণে এ দুটি এয়ারলাইন্সও বন্ধ হয়ে যায়।

ইউনাইটেড-জিএমজি-রিজেন্টের কফিনে শেষ পেরেক মেরেছে ‘সারচার্জ’

বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইন্সগুলোর মালিকেরা বলছেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বকেয়া পাওনার ওপর মাত্রাতিরিক্ত সারচার্জের কারণে অনেক এয়ারলাইন্স দেনা শোধ করতে পারছে না। দেনার চাপে তারা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সময়মতো পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে সারচার্জ দিয়ে পাওনা পরিশোধের নিয়ম অনেক দেশেই আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বেবিচকের হার অনেক বেশি।

বর্তমানে বেবিচকের বকেয়ার ওপর মাসে ৬ শতাংশ হারে বছরে মোট সারচার্জ দিতে হচ্ছে ৭২ শতাংশ। কয়েকটি দেশের সিভিল এভিয়েশনের ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে বার্ষিক সারচার্জ ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১২ শতাংশ, ওমানে ১০ শতাংশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এয়ারলাইন্স ভেদে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ

বেবিচকের আরোপিত এই ৭২ শতাংশ সারচার্জের বলি হয়ে চিরতরে বন্ধ হয়েছে ৩ দেশীয় এয়ারলাইন্স। ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অপারেশন বন্ধ করার সময় বেবিচকের কাছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের দেনা ছিল ৫৫ কোটি টাকা। তবে বকেয়া সারচার্জ যুক্ত হয়ে পাওনা গিয়ে ঠেকে ৩৫৫ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে ইউনাইটেডের পক্ষ থেকে ৩৫৫ কোটি টাকার মধ্যে মূল দেনা ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ফলে সারচার্জের চাপে চিরতরে ধূলিসাৎ হয় ইউনাইটেডের রানওয়েতে ফিরে আসার স্বপ্ন।

২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করা জিএমজি এয়ারলাইন্স ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালের মধ্যে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েও আর ফিরতে পারেনি। ফ্লাইট বন্ধের সময় জিএমজির কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সময়মতো পাওনা পরিশোধ না করায় তা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০ কোটি টাকায়। অতিরিক্ত চার্জের কারণে জিএমজির অধিকাংশ শেয়ারের ক্রেতা বেক্সিমকো গ্রুপ এটি চালু করতে আর আগ্রহ দেখায়নি।

২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় সব ধরনের ফ্লাইট স্থগিত করার সময় রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল ২৮৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে আবারও ফ্লাইট পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিল এয়ারলাইন্সটি। দেনার বিষয়ে রিজেন্ট বেবিচকের সঙ্গে একটা সমঝোতা করতে চেয়েছিল। তবে বেবিচক কোনোভাবেই মোটা অঙ্কের বিলে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না বলে আর ফিরতে পারেনি সংস্থাটি।

থার্ড টার্মিনাল চালাতে কতটা সক্ষম বিমান?
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলো মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। বেবিচকের একটা কমিটি করা উচিত। সেই কমিটির তদন্ত করা উচিত– একের পর এক ব্যবসা সফল এয়ারলাইন্সগুলো কেন ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। ইউএস-বাংলা ও এয়ার অ্যাস্ট্রা বর্তমানে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তারা কতদিন টিকে থাকবে এটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এসব বিষয়ে এখনই গবেষণা করে ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা করা প্রয়োজন।

বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য, এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, সম্প্রতি নভোএয়ার তাদের ফ্লাইট সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে। আমাদের আশা থাকবে নভোএয়ার ফিরে আসুক। তবে একবার ফ্লাইট বন্ধ করলে ফিরে আসা দুষ্কর হয়ে যায়। নভোএয়ারের মতো একটা সফল এয়ারলাইন্স, যাদের অ্যাকসিডেন্ট রেকর্ড শূন্য, অনটাইম পারফরমেন্স ভালো, সার্ভিস রেটিং ভালো ছিল, সবকিছু ভালো থাকা সত্ত্বেও যখন বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এটা খুবই দুঃখজনক।

বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যবসা বন্ধের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বেবিচকের পলিসি এভিয়েশন ব্যবসাবান্ধব নয়। এখানে সবক্ষেত্রে ট্যাক্স অনেক বেশি, সিভিল এভিয়েশনের চার্জ বেশি, তেলের খরচ অনেক বেশি, দক্ষ জনশক্তির অভাব এবং সিভিল এভিয়েশনের অত্যধিক সারচার্জ। পৃথিবীর কোথাও ৭২ শতাংশ সারচার্জ দিয়ে কেউ ব্যবসা করে না। এগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে না আনলে কোনো এয়ারলাইন্সই টিকবে না। এমনকি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও দীর্ঘ ৫৪ বছরে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। পলিসিগুলো পর্যবেক্ষণ ও যুগোপযোগী করতে হবে।

এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের দাম সর্বোচ্চ

দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর লোকসানের অন্যতম কারণ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় জেট ফুয়েলের অতিরিক্ত দাম। নিজেদের মতো করে মনোপলি বা একচেটিয়াভাবে দাম বৃদ্ধি করে জেট ফুয়েলের এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) অধীন পদ্মা অয়েল।

সর্বশেষ চলতি মে মাসে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে প্রতি লিটার জেট ফুয়েল কিনতে হয়েছে দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলারে। অথচ একই তেল ভারতের চেন্নাইয়ে দশমিক ৬৩ মার্কিন ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ৫৮, শারজায় ৬৪, চীনের গুয়াংজু-তে ৫৪, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ৫৯ ও সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দরে দশমিক ৫৭ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়।

এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ বলেন, মেইনস্ট্রিম ধরতে গেলে জিএমজি, ইউনাইটেড ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ছিল। তাদের বড় বহর এবং সুনাম থাকার পরও তারা টিকে থাকতে পারেনি। এয়ারলাইন্সগুলো ১৪-১৫ বছরের সাইকেল ব্রেক করতে পারছে না। যেকোনো এয়ারলাইন্সের জন্য সবচেয়ে বড় খরচ হচ্ছে জেট ফুয়েলের খরচ। বাংলাদেশে ফুয়েলের খরচ পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। তাহলে আমাদের দেশের এয়ারলাইন্স কীভাবে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকবে? এছাড়া পৃথিবীর সব দেশে ৮ থেকে ১২ শতাংশ সারচার্জের বিপরীতে বাংলাদেশে বছরে ৭২ শতাংশ সারচার্জ নিচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এয়ারলাইন্সের কোনো আয় ছিল না। ওই মাসগুলোতে আমরা কীভাবে সারচার্জ দেব? উচ্চ সারচার্জের কারণে সিভিল এভিয়েশন তাদের মূল পাওনাও হারাচ্ছে।

আকাশচুম্বী ল্যান্ডিং-পার্কিং চার্জে বিপর্যস্ত এয়ারলাইন্সগুলো

এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো থেকে যে ল্যান্ডিং-পার্কিং চার্জ আদায় করা হচ্ছে তা পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এতে করে যেকোনো এয়ারলাইন্সের ঢাকার বিমানবন্দরে ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে যায়।

এয়ারলাইন্সগুলো জানায়, বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের একটি প্লেন ঢাকায় অবতরণ করলে ১৫৪০ মার্কিন ডলার ও তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার টাকা। অথচ একই প্লেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর নামলে তাকে মাত্র ১৫ হাজার ৫৩৭ টাকা ল্যান্ডিং চার্জ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ একই প্লেন ঢাকায় নামলে মালয়েশিয়ার চেয়ে ২ লাখ ৭ হাজার টাকা বেশি চার্জ দিতে হয়। এই আকাশচুম্বী চার্জ যাত্রীদের টিকিটের দামেও প্রভাব ফেলছে।

এয়ারলাইন্সগুলোর পক্ষ থেকে বারবার বেবিচক এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বিষয়গুলো জানানো হলেও তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। চার্জও কমায়নি।

বর্তমানে দেশীয় ও বিদেশি সব এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বোয়িং ৭৩৮-৮০০ মডেলের প্লেনের জন্য বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ নিচ্ছে ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার বা ৩ লাখ ৬ হাজার টাকা। অথচ মালয়েশিয়া পৃথিবীর অন্যতম একটি বড় বিমানবন্দর। সেখানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে চার্জ মাত্র সাড়ে ৩ হাজার রিঙ্গিত বা ৯৭ হাজার ৫৪৫ টাকা।

আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মো. কামরুল ইসলাম। বর্তমানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, মোটা দাগে বলতে গেলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে অতিরিক্ত জেট ফুয়েলের দাম, বিমানবন্দরের উচ্চ চার্জ এবং উচ্চ করের কারণে এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার পর কয়েকটি এয়ারলাইন্স অপারেশনে ফেরার চেষ্টা করলেও বেবিচকের বকেয়া চার্জের ওপর বার্ষিক সারচার্জে পিষ্ট হয়ে তাদের ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়। দেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে।

� পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ �







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: [email protected]
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status