ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫ ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
এনসিপি নেতাদের ভাষ্যেও গড়মিল
জুলাই শহীদের প্রকৃত সংখ্যা কত?
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Monday, 5 May, 2025, 5:28 PM

জুলাই শহীদের প্রকৃত সংখ্যা কত?

জুলাই শহীদের প্রকৃত সংখ্যা কত?

জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি। সরকারি গেজেটের সঙ্গে মিল নেই জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের। উপদেষ্টা যখন জাতিসংঘকে উদ্ধৃত করছেন, তখন ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা বলছেন এনসিপির নেতারা।  

এখন পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ৮৩৪ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। 

কিন্তু ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন'-এর ওয়েবসাইটে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা হিসাবে উল্লেখ রয়েছে ৮২০+ (৪ মে ২০২৫)। সংখ্যাটি সরকার প্রকাশিত গেজেটে উল্লেখ করা সংখ্যার চেয়েও কম।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন যখন রেফারেন্স

২৮ এপ্রিল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যখন আমরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলি, তখন জাতীয় ঐক্যের কথার মধ্যে কি আমরা, ধরেন, যে মানুষ ১৪শ মানুষ খুন করেছেন জুলাইতে, তার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে; তার বিচার, অনুশোচনা, ক্ষমা কোনো কিছুই ঘটেনি, আপনি কি আমাকে বলছেন, তার সঙ্গে এখন জাতীয় ঐক্য করবার জন্য? আই থিংক দিস ইজ অ্যাবসার্ড।

১৪শ সংখ্যাটি নিয়ে ফের প্রশ্ন করা হলে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আই অ্যাম টকিং অ্যাবাউট ইউনাইটেড ন্যাশনস রিপোর্ট। ভাই, প্লিজ, ডু সাম রিসার্চ। আই অ্যাম টকিং অ্যাবাউট ইউএন রিপোর্ট।

কী আছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে?

এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ন্ত্রণে তৎকালীন সরকারের দমন-পীড়ন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা বিশ্বাস করার ভিত্তি আছে যে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তৎকালীন সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামো, আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে পদ্ধতিগতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত মৃত্যুর তথ্যের ভিত্তিতে, প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১৪শ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে, এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে থেকেও ১৪৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন বলে তালিকা দেওয়া হয়েছিল জাতিসংঘের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। 

তবে, সব মৃত্যুর ঘটনা স্বাধীনভাবে তদন্ত করা সম্ভব হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপের সবশেষে বলা হয়েছে, একজন অপরাধীর অপরাধ প্রমাণে এসব মান প্রমাণক হিসেবে ফৌজদারি কার্যধারায় অপরাধ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের চেয়ে কম। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আরো ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।

প্রসঙ্গটি ধরে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ডয়চে ভেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে জাতিসংঘের বক্তব্য এবং সরকারি গেজেটের বিষয়টি তার নজরে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, জুলাইয়ের শহীদের সংখ্যা হিসাবে কোন তথ্যটি গ্রহণযোগ্য?

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের উদ্দেশে 'ভাই, প্লিজ, ডু সাম রিসার্চ' বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি দেখার পরামর্শ দিলেও সংস্কৃতি উপদেষ্টা ডয়চে ভেলের প্রশ্নের উত্তরে জানান, অনুগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলুন। ধন্যবাদ।  

এনসিপি নেতাদের ভাষ্যেও গড়মিল

৩০ এপ্রিল ঢাকার মিরপুরে এক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।

সেদিন কর্মসূচি সম্পর্কে সংবাদকর্মীদের তিনি বলেন, ' জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে সহস্রাধিক, ১৪শরও বেশি শহীদ হয়েছে এবং হচ্ছে ৩০ হাজারের কাছাকাছি মানুষকে আহত করেছে, এই সবগুলা, এই যে গণহত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, এই গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে বিচার নিশ্চিত করাসহ এবং রেজিস্ট্রেশন বাতিল, নিবন্ধন বাতিল এবং এই জুডিশিয়ারি পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের জন্য আমরা আগামী ২ তারিখ (২ মে) বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে বিক্ষোভ মিছিল করবো।' 

তার কথায় পাওয়া গেল, ‘জুলাই শহীদ' এর সংখ্যা এক হাজার চারশ'রও বেশি।

ওইদিন বগুড়া সফরে গিয়ে এক রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে বক্তব্য রাখেন এনসিপি-র উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনিও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। সেদিনের বক্তব্যে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন তিনি।

সারজিস বলেন, এই আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র ২৪-এর জুলাইয়ে হাজারের অধিক আমাদের ভাই-বোনকে খুন করেনি, এই আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ছিল ব্যাপারটি এমন নয়, এই আওয়ামী লীগ পুরো বাংলাদেশে জেলার নাম ধরে, ব্যক্তির নাম ধরে, দলের নাম ধরে বৈষম্য করেছে।

সারজিসের বক্তব্যে পাওয়া গেছে, 'জুলাই শহীদ'-এর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। 

২০২৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক সংবাদ সম্মেলনে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা ঘোষণা করে। সেদিন উপস্থিত নেতারা জানিয়েছেন শহীদের সংখ্যা এক হাজার ৫৮১, তবে সেদিন তারা জানিয়েছিলেন, সংখ্যাটি চূড়ান্ত নয়। 

শহীদের সংখ্যা ‘সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন'

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব ফয়েজ আহম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকার এখন পর্যন্ত ৮৩৪ জনের বিষয়ে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হতে পেরেছে। সেই মর্মে সরকারি গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাদেরকে 'জুলাই শহীদ' হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যান্য আরো অনেকগুলো দাবি এবং আরো অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে, আরো অনেকগুলো মৃত্যুর বিষয়ে সরকার এখনো তদন্ত করছে, যাচাই-বাছাই করছে। 

জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বিষয়টিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতিসংঘের মতো সংস্থা থেকে ১৪শ সংখ্যাটা যখন সামনে আসে, এটা আসলে অনেক গুরুত্ব পেয়েছে। সংখ্যা হিসাবে এই কথাটা আলোচনায় এসেছে। সেজন্য জাতিসংঘের বিষয়টা সংখ্যা হিসাবে নানা বক্তব্য, বয়ানের মধ্য দিয়ে আসছে। কিন্তু 'জুলাই শহীদ' কারা এবং কত জন সেটা চূড়ান্ত হবে গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ৮৩৪ জনের নাম ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, (জুলাই শহীদ) এই সংখ্যাটা সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এটার সঙ্গে সরকারের কোনো দ্বিমত নেই। এই লক্ষ্যে সরকার কিন্তু কাজ করে যাচ্ছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের এই কর্মকর্তা বলেন, সরকার চায়, জুলাই শহীদের সংখ্যা নিয়ে যেন ভবিষ্যতে কোনো ধরনের বিতর্ক না থাকে। বিতর্কহীন, বিতর্কমুক্তভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।

'জুলাই আন্দোলন ছিনতাই হয়ে গেছে'  

পুরো বিষয়টিকে সরকারের 'চরম ব্যর্থতা' হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, সরকারের উচিত ছিল, এই ব্যর্থতাটাকে না দেখানো। এটাকে সফল করা কোনো কঠিন কাজ ছিল না। খুব সহজ একটা কাজ ছিল। সেই সহজ কাজটাকে তারা এতটাই কঠিন করে তুলছে, এটা আগামীতে জটিল আকার ধারণ করবে।

তিনি বলেন, স্বল্পতম সময়ে ছিনতাই হওয়া আন্দোলনের নাম বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন। এ আন্দোলন ছিনতাই হয়ে গেছে। এই আন্দোলনকে নিয়ে এখন ব্যবসা হচ্ছে। 

জুলাই অভ্যুত্থান আন্দোলনের সুফল ভোগীদের নিয়েও প্রশ্ন আছে এই সিনিয়র সাংবাদিকের। তিনি বলেন, এই আন্দোলনের সুফল যারা ভোগ করছেন, তারা এই আন্দোলনের যারা শহীদ এবং আহত, তাদের সঙ্গে মশকরা করছেন। এর একমাত্র কারণ হলো, এই আন্দোলনের ফলে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেছেন, তাদের ৮০ পার্সেন্ট লোকের এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনো ধরনের মানসিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না। ইনক্লুডিং ডক্টর ইউনূস।

আন্দোলনের প্রকৃত চেতনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, বলে মন্তব্য করতেও পিছপা হননি মাসুদ কামাল। সরকারি ভাষ্যে জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার নিয়েও সমালোচনা করেছেন তিনি।  

মাসুদ কামাল বলেন, কত হাস্যকর অবস্থায় আছি! সরকার এই দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। সেই সরকারের একজন উপদেষ্টা নিহতের তালিকার জন্য নির্ভর করছে বিদেশের একটা প্রতিষ্ঠানের উপর। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? 

জাতিসংঘের কয়েকজন প্রতিনিধি মিলে যদি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে, সরকার কেন পারলো না?—এমন প্রশ্ন রেখে মাসুদ কামাল বলেন, সরকারকে কেন অন্য একটা সংস্থার অনুমিত তালিকার উপর নির্ভর করতে হয়? কারণ, সরকার পারে নাই, সরকারের ব্যর্থতা।

৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে যারা সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন, তাদের হত্যার বিচার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই সাংবাদিক। তিনি বলেন, ওই দশ দিনের বিষয়ে সরকারের বক্তব্য কী? ওই দশ দিনে যারা মারা গেছেন, তারা কি মানুষ নন? তাদের পরিবার নেই? ওদের কি দুঃখ নেই? তাদের কথা কে বলবে? তাদের বিষয়ে এই সরকারের ভূমিকা কী?''

জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারেরও ন্যায়বিচার পাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। 

� পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ �







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: [email protected]
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: এমদাদ আহমেদ | প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ | কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status