কোকেন, কান্না আর হুমার হারিয়ে যাওয়া: ওয়াসিম আকরামের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়
নতুন সময় ডেস্ক
|
![]() কোকেন, কান্না আর হুমার হারিয়ে যাওয়া: ওয়াসিম আকরামের জীবনের অন্ধকার অধ্যায় কী লিখেছেন ওয়াসিম আকরাম অনেক পাঠক বইটি পড়বেন বল টেম্পারিং, ম্যাচ-ফিক্সিং ও থ্রোয়িংয়ের মতো বিতর্কিত ঘটনা জানার জন্য। কিছু ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা আমার জন্য সহজ, কারণ আমার লুকানোর কিছুই নেই। আমার গল্পের যে অংশটি বলা সবচেয়ে কঠিন, তার সঙ্গে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু নিজের কাছে সৎ থাকতে হলে আমাকে তা বলতেই হবে। দীর্ঘ সময় ধরে আমি হুমার জন্য ভালো স্বামী ছিলাম না, তেমনি তাহমুর ও আকবরের জন্য ভালো বাবাও ছিলাম না। আমি ছিলাম পাঞ্জাবি পুরুষ অভিভাবকের মতো; মাঝেমধ্যে উপহার নিয়ে হাজির হতাম, কিন্তু সন্তান লালন-পালনের পুরো দায়িত্ব স্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে, ছেলেরা সম্ভবত আমাদের পারিবারিক সাহায্যকারী মুহাম্মদ আব্বাসকে আমার চেয়ে বেশি দেখত। আমি সত্যিই জানতাম না কী করতে হবে। এর সঙ্গে ছিল খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকা স্বার্থপরতা ও অলসতার বৈশিষ্ট্য। যারা সবকিছু নিজেদের জন্য করিয়ে নিতে অভ্যস্ত। আমার নিজেকে প্রশ্রয় দিতে ভালো লাগত, পার্টি করতে ভালো লাগত। হুমা ক্রিকেট–তামাশা কখনোই উপভোগ করত না। খেলা দেখতে পছন্দ করত না। শুধু ভালোবাসার টানে আমার সঙ্গে সফরে যেত। আমার সন্দেহ হয়, স্বামীর ওপর ক্রিকেটের প্রভাব দেখে সে ছেলেদের খেলাটি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আসলে তাদের কখনোই ক্রিকেটের প্রতি কোনো আগ্রহ জন্মায়নি, যা নিয়ে আমি অখুশিও নই। তবে এতে আমি ক্রমে একা হয়ে পড়ছিলাম। আমি প্রচুর ভ্রমণ করতাম, টক শোতে অংশ নিতাম, বিজ্ঞাপন করতাম। এমনকি আমি ভারতের একটি রিয়েলিটি ডান্স প্রতিযোগিতা ‘এক খিলাড়ি এক হাসিনা’তেও বিচারক ছিলাম। দক্ষিণ এশিয়ায় খ্যাতির সংস্কৃতি একধরনের নেশা তৈরি করে। এটি আপনাকে প্রলোভন দেখাবে আর ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেবে। এক রাতে দশটা পার্টিতেও যাওয়া যায়, কেউ কেউ সেটাই করে। এই জীবনযাত্রা আমাকেও ক্লান্ত করে তুলেছিল। আমার সহজ অভ্যাসগুলো ক্রমে বদভ্যাসে পরিণত হলো। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, আমি কোকেনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। শুরুটা হয়েছিল ইংল্যান্ডের এক পার্টিতে, কেউ সামান্য একটু দিয়েছিল, সেটাই প্রথম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার আসক্তি বাড়তে লাগল। একটা পর্যায়ে এমন হলো যে মনে হতো, স্বাভাবিক চলাফেরা করতেও আমাকে এটা নিতেই হবে। কোকেন আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। মিথ্যুক করে তুলেছিল। দিনে এক ঘণ্টা আমি আমাদের ছোট ব্যায়ামাগারের চারপাশে জম্বির মতো ঘুরে বেড়াতাম। সেখান থেকে আমার বাবার অফিস দেখা যায়, যদিও তিনি জানতেন না আমি কোথায় আছি। আমি জানি, হুমা এই সময় ম্যানচেস্টার ও লাহোরে প্রায়ই একা থাকত। সে করাচিতে তার মা–বাবাা ও ভাইবোনদের কাছে যেতে চাইত। আমি ছিলাম দ্বিধাগ্রস্ত। একটা কারণ ছিল করাচিতে আমার একা যেতেই ভালো লাগত। অজুহাত দিতাম কাজের, কিন্তু আসল কাজ ছিল পার্টি করা। এখন এটি স্বীকার করতে যতটা খারাপ লাগছে, তখন স্বীকার করা আরও কঠিন ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, হুমা একপর্যায়ে আমাকে ধরে ফেলেছিল। আমার ওয়ালেটে কোকেনের একটি প্যাকেট খুঁজে পায় সে। স্ত্রী এবং মা হিসেবে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা, সেটাই দেখিয়েছে। সে বলল, ‘আমি জানি তুমি মাদক নিচ্ছ, তোমার সাহায্য দরকার।’ আমি রাজি হলাম। কারণ, ওটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। প্রথমে ছিল সামান্য একটু, এরপর বাড়তে বাড়তে এক গ্রাম, দুই গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল। আমি ঘুমাতে পারতাম না। খেতে পারতাম না। ডায়াবেটিস ছিল, সেদিকে অমনোযোগী হয়ে পড়লাম। আমি একটা পুনর্বাসন প্রোগ্রামে ভর্তি হতে রাজি হলাম। আমার তখন সেরে ওঠা দরকার। সিনেমায় রিহ্যাব বোঝাতে একটি যত্নশীল, লালন–পালনের পরিবেশ দেখানো হয়। কিন্তু লাহোরের ওই রিহ্যাব ছিল খুব বাজে। পাঁচটি কক্ষ, একটি মিটিং রুম, একটি রান্নাঘরসহ একটি খালি ভবন। ডাক্তারটা ছিল বাটপার ধরনের। রোগীর চিকিৎসার বদলে সে মূলত পরিবারকে উল্টাপাল্টা বোঝাত। ব্যবহারকারীদের মাদক থেকে আলাদা করার পরিবর্তে স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ছিল তাঁর মূল চিন্তা। প্রতি সপ্তাহের জন্য ২ লাখ রুপির বেশি চার্জ করত। আমাকে প্রথমে জানানো হয়েছিল এক মাস থাকতে হবে। দুই দিন পরই জানানো হলো, অন্তত তিন মাস থাকতে হবে। চিকিৎসা বলতে ছিল শরীর নিস্তেজ করে রাখা, সকালে ও সন্ধ্যায় মুঠো মুঠো ট্যাবলেট খাওয়া, সঙ্গে বক্তৃতা আর প্রার্থনা। আমার খুব আলসেমি ভর করত। ওজন বেড়ে গিয়েছিল। দিনে এক ঘণ্টা আমি আমাদের ছোট ব্যায়ামাগারের চারপাশে জম্বির মতো ঘুরে বেড়াতাম। সেখান থেকে আমার বাবার অফিস দেখা যায়, যদিও তিনি জানতেন না আমি কোথায় আছি। এ সবের বাইরে শুধু মন খারাপ করে বসে থাকা ছাড়া আমার করার কিছুই ছিল না। এক মাস আমি হুমা, তাহমুর ও আকবরকে দেখিনি। যখন তারা দেখা করতে এল, আমি রেগে হুমাকে বললাম, ‘আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে। আমাকে কাজ করতে হবে। আমাকে আমার বসকে ফোন করতে হবে। নইলে তারা আমাকে বরখাস্ত করবে!’ ডাক্তার বিজয়ীর মতো হাসলেন। বেশ আত্মতৃপ্তির সঙ্গে হুমাকে বললেন, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম, সে এরকমই করবে!’ আমি আমার দিক থেকে পুরো মেয়াদ থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আরও সাত সপ্তাহ পর হুমা যখন বুঝল ডাক্তার একজন বাটপার, তখন বের করে নিয়ে এল। বের হওয়ার পর আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করি, স্থির হওয়ার চেষ্টা করি। এমন সময়ে শাহরুখ খান আমাকে কলকাতা নাইট রাইডার্সে বোলিং কোচের একটি আকর্ষণীয় চাকরি প্রস্তাব করে। এটি ছিল কোনো সিনিয়র দলে আমার প্রথম কোচিং। কয়েক মাস পর যখন আহসান এল, হুমা তাকে বলল, ‘ওয়াসিমকে আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে, যদিও আমি নিশ্চিত নই।’ সে ঠিকই বলেছিল। যতই চেষ্টা করি না কেন, আমার ভেতরে একটা অংশ তখনো ধিকধিক করে জ্বলছিল। সেই অপমানের জন্য, যেটা আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল। আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছিল, আর আগের জীবনের মোহ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। একপর্যায়ে আমি বিবাহবিচ্ছেদের কথাও ভাবছিলাম। শেষমেশ ঠিক করলাম, ২০০৯ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে চলে যাব। সেখানেই হুমার নিয়মিত নজরদারির বাইরে গিয়ে আমি আবার কোকেন ব্যবহার শুরু করলাম। আমি যখন পুরোনো জীবনের স্বাদ নিতে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন লাহোরে হুমা, তাহমুর আর আকবরের গলা খারাপ হয়ে গেল। আজও ঠিক জানি না কেন এমন হলো। ঘটনার শুরু হুমার দাঁতের ডাক্তারি পরীক্ষার পর, সম্ভবত সেখানেই কোনো সংক্রমণ হয়েছিল। যাহোক, ছেলেরা ধীরে ধীরে সেরে উঠল। কিন্তু হুমার অবস্থার উন্নতি হলো না। আমি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে চলে গেলাম গুরুগাঁওয়ে কেকেআর বোলারদের ক্যাম্পে যোগ দিতে। কিন্তু আমি সেখানে থাকতেই হুমার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকল। অবশেষে ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর হুমাকে ন্যাশনাল ডিফেন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা–নিরীক্ষায় তার সংক্রামক এন্ডোকার্ডাইটিস ধরা পড়ে। কথা বলে যা বুঝলাম, হুমার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম লাহোরে ফিরে যাব। লাহোরে পৌঁছে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হুমার শারীরিক অবস্থা এতটা খারাপ হয়ে গেছে ভাবতেও পারিনি। আর বিস্ময় লাগল যখন দেখলাম যে ডাক্তাররা একটি সরল প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে পারছেন না। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তাকে ডক্টরস হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হবে, যদি তার হার্ট ভাল্ব প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। আমাকে জানানো হয় চিকিৎসা বিল শেষ পর্যন্ত দুই লাখ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। হুমার উন্নতির কোনো লক্ষণই দেখছিলাম না। মনে হচ্ছিল ডাক্তাররা সবকিছুতে অমনোযোগী, শুধু নিশ্চিত করছিলেন যে আমাদের কী কী বিল যোগ হচ্ছে। দিন দিন আমার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। হুমারও। মনে আছে, তার বিছানার পাশে বসে আছি, সে আমার নতুন গজানো দাড়ি ধরে আদর করছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘যদি আমার কিছু হয়, ছেলেদের কী হবে?’ আমি সান্ত্বনা দিয়ে উত্তর দিলাম, ‘জান, তোমার কিছুই হবে না। আর আমি ছেলেদের দেখাশোনা করার জন্য এখানে আছি।’ সে শুধু হাসল। জানত যে আমার মতো পাঞ্জাবি বাবার দ্বারা কখনো ছেলেদের দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। আমরা তখনো পাকিস্তানে। কিন্তু অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার ছিল। সিঙ্গাপুরের এক বন্ধু আমাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানে, বিশেষ করে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলল। খরচ আকাশছোঁয়া, ১ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। কিন্তু মনে হচ্ছিল চিকিৎসকদের মনোযোগ পাওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। ২০ অক্টোবর আমার শ্যালকসহ হুমাকে নিয়ে বিমানবন্দরে রওনা হওয়ার সময় পরীক্ষা করার জন্য একজন ডাক্তারও পাওয়া যায়নি। আমাদের হোপ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ওড়া শুরুর পর আধা ঘণ্টার মতো কেটেছে, এমন সময়ে হুমা হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমার স্বামী কোথায়?’ আমি তার হাত ধরে বললাম, ‘আমি এখানেই আছি।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হুমা চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্থিরতা দেখা দিল, সে কষ্ট পাচ্ছে। প্লেনে থাকা ইমারজেন্সি মেডিকেল টিম তাকে ইন্ট্রাভেনাস ডায়াজেপাম দেয়, আর তখনই তার হৃদ্যন্ত্র থেমে যায়—কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করেন, আধা ঘণ্টা ধরে প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত হালকা একটা স্পন্দন ফিরে আসে। এরপর আমরা উড়ে গেলাম চেন্নাইয়ের দিকে, সেখানে অ্যাপোলো হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি এতটাই ভয় আর দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে বন্ধুবান্ধবকে ফোন করে কাঁপা কণ্ঠে বলছিলাম, হুমা হয়তো আর বাঁচবে না। হার্ভে পরে বলেছিল, আমি তাকে ফোন করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু কী বলছিলাম, সে কিছুই বুঝতে পারেনি। চেন্নাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন আমরা নামি, তখন আমাদের প্রয়োজনীয় কোনো অনুমতিই ছিল না, আমাদের ভিসাও ছিল না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেসব নিয়ম ছাড় দিয়েছিল। অ্যাপোলো হাসপাতালও কোনো বিল চায়নি। ওদের সেই সহানুভূতির কথা আমি কখনো ভুলব না। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। হুমার ব্রেন স্টেমে মারাত্মক আঘাত লেগেছিল। নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারছিল না, মেশিনের সাহায্যে শ্বাস চলছিল। হুমা প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আমিও তাকে ধরে রাখার জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ২৫ অক্টোবর সে চলে গেল। তার বয়স ছিল মাত্র ৪২ বছর। হুমা মুফতির মৃত্যুর কয়েক বছর পর ২০১৩ সালে ওয়াসিম আকরাম দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন অস্ট্রেলিয়ার শানিয়ারা থম্পসনকে। তাঁরা এখন করাচি ও সিডনি—দুই জায়গাতেই থাকেন। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। হুমার ঘরের দুই ছেলের একজন অস্ট্রেলিয়ায়, অন্যজন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ক্রিকেটের বাইরে আকরাম নিয়মিত টেলিভিশনে বিশ্লেষক হিসেবে উপস্থিত হন এবং বিভিন্ন লিগে কোচ ও পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। সেই সঙ্গে তিনি ডায়াবেটিস ও মাদকাসক্তি থেকে উত্তরণসহ বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক প্রচারণায় অংশ নিয়ে থাকেন। বইটি প্রকাশের পর মাদকাসক্তি ও পারিবারিক সংকটের মতো স্পর্শকাতর বিষয় প্রকাশ্যে আনায় ওয়াসিম আকরামের সাহসিকতা প্রশংসিত হয়। |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |