সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে প্রধান আসামী করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হিরু-হুমায়ুন গুমের মামলা
শারমিন সুলতানা, লাকসাম:
|
![]() সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে প্রধান আসামী করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হিরু-হুমায়ুন গুমের মামলা মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাত ৯টা। বিএনপি’র টানা অবরোধ চলছিল। স্থানীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজ। তৎকালীন সময়ে কনকনে শীত ছিল। ওই সময় বিদ্যুতের তেমন লোডশেডিং না থাকলেও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আসার কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে লাকসাম শহর। লাকসামে বিশেষ অভিযান চালায় র্যাব-পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। একপর্যায়ে র্যাবের সদস্যরা উপজেলা বিএনপি সভাপতি সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুর মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ প্রায় এক ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে গ্রেফতার করেন। র্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে ওই রাতেই সাইফুল ইসলাম হিরু, পৌর বিএনপি’র সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ এবং একই কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে লাকসাম থেকে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা করেন। তাঁদের বহনকারী অ্যাম্বুল্যান্সটি কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছলে সাদা পোশাকধারী একদল লোক অ্যাম্বুল্যান্সটিকে গতিরোধ করে। পরে গতিরোধকারীরা নিজেদের র্যাব পরিচয়ে দিয়ে তাঁদের আটক করে অন্য একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়। ওইদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে জসিম উদ্দিন (অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা) এবং লাকসামে গ্রেফতার হওয়া ৯ জনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করেন র্যাব-১১ এর কুমিল্লা শাখার তৎকালীন ডিএডি শাহজাহান আলী। পরদিন সকালে তাদের জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এতে জসিম রক্ষা পেলেও শেষরক্ষা হয়নি বিএনপি নেতা হিরু ও হুমায়ুনের। গুমের ঘটনায় মামলা: চাঞ্চল্যকর এ গুমের ঘটনায় ২০১৪ সালের ১৮ মে হুমায়ুন কবির পারভেজের বৃদ্ধ পিতা রঙ্গু মিয়া বাদী হয়ে অপহরণের পর গুমের অভিযোগ এনে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-১১ এর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র্যাব ১১-এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কম্পানি-২ এর মেজর শাহেদ হাসান রাজীব, উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়কে অভিযুক্ত করা হয়। ওইদিন আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য লাকসাম থানার ওসি নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট ছেলে হারানোর শোকে মারা যান হুমায়ুনের বৃদ্ধ পিতা ও মামলার বাদী রঙ্গু মিয়া। পরে রঙ্গু মিয়ার মৃত্যুতে তাঁর ছোট ছেলে গোলাম ফারুকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে ওই মামলার বাদী হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করে। র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ওই মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন কয়েক দফা সময় নিয়ে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর আদালতে দাখিল করে লাকসাম থানা পুলিশ। দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন: হিরু-হুমায়ুন গুমের মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করেন, র্যাব কর্তৃক দুই ভিকটিমকে অপহরণ করা হয়েছে বলে মামলার সাক্ষীরা বক্তব্য দিলেও প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণে তার সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের মাধ্যমে তাঁরা অপহৃত হতে পারেন। ওই সময়ে পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান মামলার বাদী। পরে বাদীপক্ষের নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত মামলাটি সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় নিয়ে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি, কুমিল্লার অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মদ তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এতে র্যাব কর্তৃক দু’জনকে অপহরণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রতিবেদনে দুই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ‘আত্মগোপনে’ থাকতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর পিবিআই হয়ে বর্তমানে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করছেন লাকসাম সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সৌমেন মজুমদার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা: বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) গুম হওয়া হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই গোলাম ফারুক বাদী হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামী করা হয়েছে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. তাজুল ইসলামকে। এছাড়াও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-১১ এর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র্যাব ১১-এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কম্পানি-২ এর মেজর শাহেদ হাসান রাজীব, উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায় ও লাকসাম থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়েরকে আসামী করা হয়। হিরু-হুমায়ুন গুম মামলার আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন বলেন, সাইফুল ইসলাম হিরু এবং হুমায়ুন কবির পারভেজ গুমের পর ২০১৪ সালের ১৮ মে আদালতে একটি দায়ের করা হয়। মামলাটি দায়েরের পর যারাই তদন্ত করেছে তাদের কেউই ঘটনায় অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘটনাটি ধামাচাপ দিয়ে রাখা হয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে সুবিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আশা রাখি বাদীপক্ষ এবার সুবিচার পাবেন।
|
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |