মানিকগঞ্জের ঐতিহ্য হাজারী গুড়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে এই গুড়ের সুনাম ও ঘ্রাণ।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের ঝিট্কা শিকদারপাড়া (গাছিপাড়া) এলাকায় উৎপত্তি হওয়া এই গুড়ের চাহিদাও রয়েছে প্রচুর চাহিদা। সেই সুনাম আর চাহিদাকে পুঁজি করে পাঁচবছর ধরে ট্রেডমার্ক প্রতারণার মাধ্যমে গাছিদের এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম হাজারী (শামীম)। ট্রেডমার্কের দোহাই দিয়ে আইনি কোনো অধিকার না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গাছিদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন তিনি। ট্রেডমার্ক নম্বর ২২৮৮৪৮ ব্যবহার করে তিনি তৈরি করেন গুড় তৈরির প্যাকেট। ট্রেডমার্কের কারণে তিনি এই গুড়ের মালিক এবং তার অনুমতি ছাড়া এই গুড় তৈরি ও বিক্রি করা যাবে না বলে সবাইকে জানান তিনি। তার প্যাকেটের বাইরের গুড় ভেজাল ও ভুয়া বলেও প্রচার করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।
ট্রেডমার্ক প্রতারণার মাধ্যমে কোনো চালান ছাড়াই প্যাকেট ও গুড় বিক্রির মাধ্যমে তিনি প্রতি বছর প্রায় ১০-১২ লাখ টাকা আয় করছেন। স্থানীয়রা জানান, হাজারী পরিবারের কেউ দীর্ঘদিন ধরে গুড় তৈরি করেন না। তাদের বাড়িতে যারা সেই সময় রাখাল (শ্রমিক) থাকতেন তারাসহ বিভিন্ন গাছিরা উৎপাদকের কাছে থেকে গুড় তৈরির প্রক্রিয়া শেখেন। অনেকে আবার হাজারী পরিবার থেকে সিলমোহর নিয়েও গুড় বিক্রি করতেন। তবে, আগে এ নিয়ে হাজারী পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা বা আলাদা কোনো টাকা কেউ দাবি করতেন না। কিন্তু শামীম হাজারী ট্রেডমার্কের ভয় দেখিয়ে ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সব গাছিকে তার অধীনে করে নেন। বর্তমানে তার অধীনে রয়েছে প্রায় ৩০ জন গাছি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গাছি বলেন, ট্রেডমার্কের কথা বলে শামীম হাজারী তার বাইরে গুড় তৈরি ও বিক্রিতে বাঁধা দেন তিনি। বাগে আনতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গাছিদের হুমকি-ধামকি ও প্রশাসনের ভয়ও দেখিয়েছেন। এখন প্রত্যেক গাছিকে তাদের উৎপাদিত চার ভাগের তিন ভাগ গুড় শামীম হাজারী ও তাদের ভাইদেরকে দিতে হয়। বাকি এক ভাগ বাইরে বিক্রি করতেও তাকে অনুরোধ করতে হয় গাছিদের।
তিনি গাছিদের গুড় প্রতিকেজি ১২০০ টাকা করে দেন। কিছু বেশি টাকা চাইলে গাছিদের তিনি গুড় তৈরি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। তাই গাছিদের কষ্টের ফল ভোগ করতে পারেন না গাছিরা। গুড় তৈরির গাছি ও গুড় ব্যবসায়ীরা জানান, এক কেজি গুড়ে চারটি পাটালি হয়। প্রতিটি পাটালির জন্য দেয়া হয় একটি করে প্যাকেট। এছাড়া এক থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত গুড়ের জন্য রয়েছে আলাদা প্যাকেট। প্রতি কেজি গুড় কিনতে ক্রেতাদের কমপক্ষে ১০০-১২০ টাকা প্যাকেটের পেছনেই খরচ হয়। মৌসুমে প্রতিদিন ৭০-৮০ কেজি গুড় বিক্রি হয়। বাজারে যা বিক্রি হচ্ছে ১৬০০-২২০০ টাকা কেজি দরে।
পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর ‘হাজারী প্রোডাক্টস’ নামে ট্রেডমার্কের ৩০ নম্বর শ্রেণিতে নিবন্ধনের আবেদন করেন হাজারী প্রোডাক্টসের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম হাজারী (শামীম)। ৩০ নম্বর শ্রেণিতে গুড় অন্তর্ভূক্ত। অন্য আরেকটি আবেদনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর তাকে বক্তব্য ও তথ্য প্রমাণ দাখিলের জন্য নোটিশ দেয়া হয়। তথ্য প্রমাণ দাখিল না করায় তার আবেদন বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে তিনি আবেদনটি পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছেন।
এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম হাজারী (শামীম) বলেন, আমার আবেদন বাতিল করা হয়েছে জানার পরে পরবর্তীতে আমি আপীল করেছি। অধিদপ্তর থেকে আমাকে এই নম্বর প্যাকেটে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন।
তবে পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ট্রেডমার্ক) মো. মেহেদী হাসান বলেন, তার ট্রেডমার্কের আবেদন বাতিলের প্রেক্ষিতে তিনি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেছেন। অনিবন্ধিত ট্রেডমার্ককে তিনি নিবন্ধিত হিসেবে প্রচার করছেন। সেটি ঠিক করছেন না। আমাদের সাজা দেওয়া বা মোবাইল কোর্ট করার এখতিয়ার নেই। কেউ যদি ওনার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে কোর্টে মামলা করে এবং তিনি যদি কোর্টে তার নিবন্ধনের বিষয়টি প্রমাণ করতে না পারেন সেক্ষেত্রে কোর্ট তাকে সাজা দিবে।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।