গান্ধী-জীবনী আত্মপ্রচারকারীদের পাঠ্য হোক
রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী
|
মহাত্মা গান্ধী ছিলেন শান্তি ও অহিংসার এক প্রবাদপুরুষ। রাজনীতিক হিসেবে বিশ্বজুড়ে নন্দিত হলেও মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ক্ষমতাবিমুখ এক মানুষ। স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করেননি। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন এমনই নির্মোহ যাঁকে কল্পকথার অতিমানবদের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। আধুনিক যুগে পৃথিবীর মাটিতে যদি অহিংসা ও শান্তির কোনো মানুষবেশী দেবদূতের আগমন হয়ে থাকে, তবে তা মহাত্মা গান্ধীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শান্তির জন্য তিনি নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করেন। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন মন্তব্য করেছিলেন, ‘কয়েক যুগ কেটে যাবে, তবু মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হবে যে এমন একজন মানুষ রক্ত-মাংসের শরীরে সত্যিই এসেছিলেন, চলাফেরা করেছিলেন মাটির পৃথিবীতে।’ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী নির্মম শাসকশোষকের বিরুদ্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের লড়াইয়ে তিনি ছিলেন এক আপসহীন নেতা। সেই একটা বিষয়ে আমরা দল-মতনির্বিশেষে সবাই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, যেমন কৃতজ্ঞ তাঁর সময়কার অন্য সব লড়াকু নেতার প্রতি। মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অব মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ’ ভারতের সংগ্রামী গণমানুষের ইতিহাস গবেষণার এক অসামান্য গ্রন্থ। এ অঞ্চলের ইতিহাস-গবেষণায় যার কোনো বিকল্প নেই। মানবপ্রেমী এম কে গান্ধী যেমন গণমানুষের মহান নেতা ছিলেন তেমনি তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থটি হয়েছে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অসামান্য দলিল-পুস্তক, পাতায় পাতায় মানবসভ্যতার মধ্যকার সব শোষণ-মুক্তির লড়াইয়ের জন্য শিক্ষণীয় সব বিষয়। এ বইটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য গান্ধী তাঁর জীবনের সব দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কথা, তার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, যেমনি বলেছেন নানা সাফল্যের প্রসঙ্গও। আমাদের বাংলাদেশে, একইভাবে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীগণ, এমনকি রাষ্ট্রনায়ক অবধি প্রায় সবাই নিজের জীবন কথা লিখতে গিয়ে আপন গুণগান করেছেন যতটা, ততটাই নির্মোহ দৃষ্টিতে আত্মসমালোচনা বা নিজ-স্বজনদের দোষত্রুটি তুলে ধরার ব্যাপারটি এড়িয়ে গেছেন সযত্নে। ফলে ওই গ্রন্থগুলো হয়েছে আত্মপ্রতারণার নামান্তর, দেশ-জনতা এবং বিশ্ববাসীকে ধাপ্পা দেওয়ার একটা নির্লজ্জ অপপ্রয়াস। ব্যক্তিগত আচরণে চরিত্রবান অনেক ব্যক্তিও লোকলজ্জার ভয়ে অনেক বাজে কাজ করেও লুকিয়ে রাখেন সেসব ঘটনা। কারণ তাতে ক্ষমতা হারানো বা দেশবাসীর সমালোচনা বা প্রবল নিন্দার মুখোমুখি হতে পারেন, সেই আতঙ্কে। কিন্তু নেতা গান্ধীর আত্মজীবনী গ্রন্থটি একেবারেই উল্টো। তিনি তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের ভুলত্রুটি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন চূড়ান্ত নির্মোহ ভাবনায় আর কঠিন-কঠোর প্রকাশ ভঙ্গিতে। গান্ধী-জীবনী আত্মপ্রচারকারীদের পাঠ্য হোকআমাদের সমাজে অনেক রাজনীতিক আছেন, তারা ক্ষমতাধর, নিজেরা যথেচ্ছ অনাচারে লিপ্ত। অন্যের সম্পদসম্পত্তি, টাকাপয়সা লুণ্ঠন করার তৎপরতায় বেজায় পারদর্শী। কিন্তু ‘বিশাল-হৃদয় ভাব’ ধরেন, প্রচুর দানখয়রাত করেন, বাড়িতে বা হোটেল রেস্তোরাঁয় অতিথি আপ্যায়ন করে অনেক অর্থ ব্যয় ও অপব্যয় করেন। এসব ব্যক্তির মধ্যে ভণ্ডামির স্বভাব ভয়ংকরভাবে পরিলক্ষিত। তবু তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজেদের মানবতাবাদী ও পরোপকারী প্রমাণের ভাব ধরে থাকেন। আসলে যে তাদের ওই সব ভণ্ডামির বিপরীতে দারুণ মতলববাজি মনোভাব সক্রিয় সেটা বেশির ভাগ মানুষই বুঝতে পারে না। তারা আসলে ভান-ভণিতা করে চলতে পছন্দ করেন, নিজেদের সম্মান-ইজ্জত বাড়াতে চান, সমাজে-রাষ্ট্রসভায় সবার সামনে নিজের সৎ গুণাবলি এমনকি সৎ গুণাবলি না থাকার পরেও ভণ্ডামি করে প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন। তাদের মধ্যে এমন দুষ্টচরিত্রের লোকও আছে সংখ্যায় যারা কয়েকজন নয়, শত শত বা তারও বেশি, এমনকি হাজার হাজার। কোনো একটা এলাকার মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বা তারও চেয়ে বেশি অসাধু লোক থাকতে পারেন, তারা সবার অজান্তে নানা রকম পাপকর্ম করেন, তবে প্রত্যক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে ধরা না পড়লে কোনোভাবেই স্বীকার করেন না। এসব ভণ্ডামি হরদম চলে দুনিয়ার সব দেশে- তবে কোথাও একটু কম, কোথাও বা বেশি হারে। সম্প্রতি ক্ষমতা থেকে ছাত্র-জনতা কর্তৃক বিতাড়িত বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট নেতা শেখ হাসিনা আর তার দলের সব নেতা প্রায় একই রকম ভণ্ড, প্রতারক। দেশ ছাড়া হলেও এখনো তাদের ষড়যন্ত্র থামেনি। স্বৈরাচার এরশাদের ভয়াবহ মিথ্যাচার আর দুর্নীতির জমানায় একজন এরশাদ-চেলা জাপা নেতার নামে স্রোগান উঠল- ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’। এসব শুনে দুর্নীতিবিরোধী সৎ মানুষজন হেসে গড়াগড়ি যেতেন। এরশাদ নিজে এবং তার সব চেলাচামুণ্ডা এ রকম প্রতারক ও ভণ্ড হবে সেটাই স্বাভাবিক। মাদারগাছে তো আর আম ফলে না। এ অঞ্চলের তথা বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানুষের নেতা এম কে গান্ধীর মূল্যবোধ, তাঁর জনমুক্তির লড়াই-সংগ্রামের আদর্শ অধ্যয়ন করেছেন সেসব নিয়ে কোথাও না কোথাও রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে হাততালি কুড়িয়েছেন এমন সব আওয়ামী লীগ নেতার অনেকেই দস্যু-ডাকাতে পরিণত হলেন কীভাবে? কয়েকজন যেমন ওবায়দুল কাদের, ড. আব্দুর রাজ্জাক, ড. হাছান মাহমুদ, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, ডাক্তার দীপু মনি (যার অনেক ডিগ্রির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমপিএইচ ডিগ্রিও আছে), সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আমির হোসেন আমু, আরও অনেকে কীভাবে গণবিরোধী পরিণত হলেন! অভিজ্ঞজনদের মতে, আওয়ামী লীগের নেতা-সংগঠকদের মধ্যে লুটেরা ও গুরুতর অপরাধীর সংখ্যা কমপক্ষে দুই লাখ। তাদের যথাযথ বিচার হলে হাজার হাজার ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হবে, অন্যদের অনেকেরই হবে যাবজ্জীবন, বাকিদের হবে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। এ লোকগুলোর বেশির ভাগই শিক্ষিত, এমনকি উচ্চশিক্ষিত, বারবার এমপি বা অন্যভাবে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। অনেকেই একবার, দুবার বা বারবার মন্ত্রী হয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা বিশাল মাপের, দেশবাসীর কল্যাণে ইতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই মানুষগুলো কীভাবে এমন দানবে পরিণত হলেন? স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী নেতাদের নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রায় পাঁচ মাস ধরে টানা ধারাবাহিক রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে, সেসব দেখলে গণমানুষের যে কারও ভিরমি খাওয়ার দশা! তারা যাদের জাতীয় নেতা মেনে রাজনীতি করে এসেছেন, তারা তো সাধারণ চোর-ডাকাত কেউ ছিলেন না। শেখ পরিবারের শেখ সেলিম, শেখ হেলাল আর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, অবশ্যই তাদের কাজিন শেখ হাসিনার ‘ফ্যাসিবাদের মান’ রক্ষা করেছেন, একেকজন দুর্নীতির বটবৃক্ষ হয়ে। আরও আছেন কুষ্টিয়ার গরু চোরাকারবারি দলের দালাল বলে কুখ্যাত মাহবুব উল আলম হানিফ। এ লোকগুলোকে দুর্নীতিতে নোবেল পুরস্কার থাকলে তা নির্বিঘ্নে দেওয়া যেত। আওয়ামী লীগে আর শেখ পরিবারে কত যে গডফাদার আর মাফিয়া আছে, তার হিসাব করে কূলকিনারা পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের সাধারণ প্রশাসন পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতিসাধন, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নাস্তানাবুদ দশা সবাইকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। এর মধ্যে অস্ত্র উদ্ধারে ধীরগতি, পুলিশ ও অন্য সব প্রশাসন সঠিক পথে আনতে সরকার নাজুক দশায়। আওয়ামী লীগের লুটেরা রাজনীতিকদের মধ্যে যথার্থ শিক্ষা ও চেতনার অভাব ছিল সেটা কিছুটা মানা যায়। কিন্তু শেখ হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়জন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, বিখ্যাত সব প্রফেসর, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর (সাবেক), অন্য সব প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্তা, যারা পিএইচডি ডিগ্রিসহ আরও অনেক ডিগ্রি নিয়ে সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন রাষ্ট্রের টাকায়, নিজেদের পণ্ডিত ব্যক্তি বলে গর্ব করতেন, তারা কেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটু ভালো বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলেন না? তারা সবাই ব্যস্ত ছিলেন মোসাহেবি, চাটুকারিতায়, স্তাবকতায় এবং নিজের আখের গোছাতে, কেন? কেন তাদের বোধবুদ্ধি এভাবে লোপ পেয়েছিল? মহাত্মা গান্ধীর গুণাবলি নিয়ে এ ব্যক্তিরাই কিন্তু লম্বাচওড়া বক্তৃতা দিয়েছেন অনেক অনুষ্ঠানে, কিন্তু নেতা-গান্ধীর আত্মজীবনী গ্রন্থটিও গভীর মনোযোগে পড়লেন না, পড়ে থাকলেও তাঁর আদর্শ ও দর্শন যে আত্মসমালোচনা তা সামান্যতমও অনুসরণ করলেন না! এসব বুদ্ধিজীবী নামধারী মোসাহেব চাটুকারের দল যদি নিজেদের সংশোধন করে ভালো মানুষ বানাতেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ভালো পরামর্শ দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র অনুসারী ‘মানবিক-শাসক’ পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করতেন তাহলে আন্দোলনকারী হাজার ছাত্র-গণমানুষ হত্যা ও হাজার হাজার ব্যক্তিকে আহত করে পঙ্গু বানাতে হতো না, ফ্যাসিস্ট অপবাদ নিয়ে শেখ হাসিনাকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হতো না, গণহত্যার দায়ে বিচারে কঠিন শাস্তির অপেক্ষায় থাকতে হতো না। অন্তত ৪০ লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্র-লুণ্ঠন করে এর বড় অংশ বিদেশে পাচার করতে হতো না। তার অনুসারীরাও বাঁচতে পারতেন সম্মান-ইজ্জত নিয়ে, রাজনীতি করতেও অসুবিধা হতো না। লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |