এক্সপ্রেসওয়ে দুর্ঘটনার হটস্পট কেন
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
পুলিশ দেখে গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেও পুলিশ দূরে চলে গেলে আবার গতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন চালকরা, বলেন হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়েটি দুর্ঘটনার ‘হটস্পটে’ পরিণত হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ সড়ক বিভাগের তথ্যমতে, এই এক্সপ্রেসওয়েতে ২০২২ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত ৯৯০টি দুর্ঘটনার ১৪০ জন নিহত ও এক হাজার ৪৪৫ জন আহত হয়েছেন। জেলার হাঁসাড়া হাইওয়ে থানা পুলিশ বলছে, এক্সপ্রেসওয়েটিতে গত এক বছরে ৬৮টি দুর্ঘটনায় ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহতের সংখ্যা দেড় শতাধিক। গত ২২ ডিসেম্বর ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর থেকে হাঁসাড়া পর্যন্ত ৪-৫ কিলোমিটার এলাকায় চারটি জায়গায় যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যানসহ ১৩টি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসব দুর্ঘটনায় কোথাও গাড়ি সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে, কোথাও একটি আরেকটির পেছনে ধাক্কা দিয়েছে। তখন মো. ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে এক বাসচালক মারা যান। পরদিন ২৩ ডিসেম্বর ঘন কুয়াশায় ধলেশ্বরী সেতুর উপর প্রাইভেট কার ও পিকআপের সংঘর্ষে এক নারী নিহত ও অন্য পাঁচজন আহত হন। ২৭ ডিসেম্বর এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় বেপরোয়া গতির বাস পিষে দেয় প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসকে। এতে দুই পরিবারের ছয়জন নিহত ও আহত হন চারজন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনার পরও সড়কে নেওয়া হয়নি বাড়তি কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, সড়কের কোথাও পুলিশের কোনো টহল নেই। সড়কের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনের নির্দিষ্ট গতিসীমা লেখা থাকলেও অধিকাংশ গাড়ির চালকই তা মানছেন না। নির্দিষ্ট গতিসীমা না মানা, চালকের অদক্ষতা, প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, শীতে ঘন কুয়াসা; সব মিলিয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটারের এ এক্সপ্রেসওয়েটি। গত শুক্রবার এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় দুর্ঘটনায় স্ত্রী, দুই কন্যা ও নাতিকে হারিয়েছেন ঢাকার জুড়াইনের ব্যবসায়ী মো. আকবাল হোসেন। তার অভিযোগ, “এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর পেছনে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে।”এ দুর্ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছেন তিনি। আলোচিত এ দুর্ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, একদিন আগে রং করে বেপারী পরিবহনের ফিটনেসবিহীন বাসটি ঢাকা-কুয়াকাটা রুটে চলাচলে জন্য সড়কে নামায় মালিকপক্ষ। একদিকে বাসের ফিটনেস সনদ তো ছিলই না, অন্যদিকে লাইসেন্স নবায়ন ছিল না চালকের। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাসচালক নুর উদ্দিন। বাসমালিক ডাবলু ব্যাপারীও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই দুর্ঘটনার জন্য ডাবলু ব্যাপারীর নিজের কোনো দোষ ছিল না দাবি করলেও ফিটনেসবিহীন বাস কেন সড়কে নামল আর মেয়াদ উত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালকের হাতেই কেন বাসটির দায়িত্ব দেওয়া হল- এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ডাবলু। শ্রীনগর ছনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন আহমেদ বললেন, “সড়কের কুঁচিয়ামোড়া, ধলেশ্বরী টোলপ্লাজা, হাঁসাড়া, ষোলঘর, পদ্মা থানা এলাকার কাছাকাছি বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ পুলিশ এসব এলাকায় নামমাত্র টহল দেয়।” একই উপজেলার হাঁসাড়া এলাকার বাসিন্দা আসলাম শেখের ভাষ্য, “দেশে আইন আছে শুধু কাগজে-কলমে, কিন্তু কোনো জায়গায় এই আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যানবাহন যেভাবে চলার নিয়ম সেভাবে চালকরা চালাচ্ছেন না।”এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলা এলাকার বাসিন্দা কমল দাস। তিনি বলেন, “যে গতিতে পরিবহনগুলো চলে, তাতে পুলিশ কন্ট্রোল করতে পারে না। এইটার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।” পথে চলা বাসচালক মোহন মিয়া বলেন, “এক্সপ্রেসওয়েতে ঘন কুয়াশার কারণে এখন বেশি সমস্যা হচ্ছে। সড়কবাতিগুলো সঠিকভাবে জ্বলছে না। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়েও পথ দেখা যাচ্ছে না। সড়কে গাড়ি থামিয়ে রাখলেও ঝুঁকি, পেছন দিয়ে মেরে দেয়। আর স্বাভাবিক সময়ে গতি বাড়িয়ে চলতে গেলেও সমস্যা হয়।” ইলিশ পরিবহনের বাসচালক মনির হোসেন বলেন, “ফিটনেস ছাড়াও অনেক যান দ্রুতগতির এক্সপ্রেসওয়েতে চলছে। আবার অনেক ট্রাকও অতিরিক্ত মালামাল বহন করছে। এর বাইরেও বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল মূল এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলে দুর্ঘটনা ঘটছে।” তার দাবি, ট্রাফিক আইন যেন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে নিয়মিত মোটরসাইকেল চালান আসিফ হোসেন। তার ভাষ্য, “শুধু মোটরসাইকেলই নয়, সব ধরনের যানবাহনই অতিরিক্ত গতিতে চলাচল করছে। বাসগুলো একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু সঠিকভাবে দেখার কেউ নেই, মাঝে-মধ্যে যে অভিযান চলে, তা একেবারেই অপ্রতুল।” গতিসীমার বিষয়ে কী বলা আছে নির্দেশনায় গত মে মাসে সড়ক ও মহাসড়কে কোন যানবাহন কী গতিতে চলাচল করতে পারবে, এ সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রকাশ করে সরকার। এতে বলা হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেনে যানবাহন চলাচলের জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। মূল সড়কে প্রাইভেট কার, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাসের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। ট্রাক-কভার্ড, মিনিট্রাকসহ সব ধরনের মালবাহী যানের গতিবেগ সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার। আর মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। আরও বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ গতিসীমার এই নির্দেশনা শুধু স্বাভাবিক সময়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা হলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য গতিসীমা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ যতটুকু গতি হলে চালক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, সেই অনুযায়ী চালাতে হবে। তবে দৃষ্টিসীমা বেশি মাত্রায় কমে গেলে বা একেবারে দেখা না গেলে যানবাহন চালানো বন্ধ রাখতে হবে। তবে বিভিন্ন পয়েন্টে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে হাইওয়ে পুলিশের স্পিডোগানে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এক একটি যাত্রীবাহী বাসের গতি থাকে সর্বনিম্ন ৯৯ থেকে সর্বোচ্চ ১২৪ পর্যন্ত। যা বলছে হাঁসাড়া হাইওয়ে পুলিশ পুলিশের টহল প্রসঙ্গে হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, প্রতিদিন রাতে দুটি গাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীর টোলপ্লাজা থেকে মাওয়া এলাকার প্রায় ২৯ দশমিক ২ কিলোমিটারে টহল দিচ্ছেন তারা। তার দাবি, পুলিশ দেখে গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেও পুলিশ দূরে চলে গেলে আবার গতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন চালকরা। তবে পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার না করে যত্রতত্র সড়ক পারাপার, যানবাহনের অবৈধ পার্কিং, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করানোর অভিযোগও আছে। ফায়ার সার্ভিস ও সড়ক বিভাগের ভাষ্য দুর্ঘটনা রোধে চালকদের সচেতন ও সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন মুন্সীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, “ট্রাফিক আইন না মেনে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের গাফিলতি, ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, যত্রতত্র গাড়ি থামানো, ত্রুটিযুক্ত গাড়ি রাস্তায় বের করার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।” শীতরাতে ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টির দিনে দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে দাবি করে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, “ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালালে, চালকদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণ ও যাত্রীরা সচেতন হলে, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।” দুর্ঘটনা এড়াতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি মুন্সীগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ মাহমুদ সুমনের। তিনি বলেন, “শীতকালে ঘন কুয়াশায় চালকদের দৃষ্টিসীমা কমে গেলে আমরা অনেক সময় টোলপ্লাজার আগে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখি।” হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার আ ক ম আকতারুজ্জামান বসুনিয়া বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন অসতর্কতা, অবহেলা, নিয়ম না মানা ও অনৈতিকতা এই যে একটা সংস্কৃতি তৈরি করেছি; বিশেষ করে পরিবহন সেক্টরগুলোতে। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এইটার জন্য আমরা শুধু ড্রাইভারদের দায়ী করব, বিষয়টা এমন না।” তার ভাষ্য, “একটি গাড়ি শুধু ড্রাইভার পরিচালনা করেন না। একটি ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে চলাচল করে। তারা যখন এই দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করেন তখন আমাদের বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।“আমরা সবাইকে বলতে চাই। মহাসড়কে বা পরিবহন সেক্টরের যেখানেই হোক না কেন, সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।” |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |