ডেঙ্গুর সংক্রমণ এবার কেন এত বাড়ছে
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে। এ বছর প্রথম ৯ মাসে ১৬৩ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শুধু গত সেপ্টেম্বরেই মারা গেছেন ৮০ জন। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। একই মাসে প্রতি সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ২০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদ, কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অক্টোবর মাসে আরও বাড়তে পারে। কারণ, রোগটি বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ের অভাব বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। তাঁদের পরামর্শ, পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আগে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারের জোর প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। অবশ্য গতকাল সোমবার ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। প্রতিটি কমিটিতে দেশের তিনজন বিশেষজ্ঞকে সদস্য করা হয়েছে। এডিস বাড়ছে, রোগী বাড়ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি মানুষ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মাসের প্রথম সপ্তাহে আক্রান্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ। মাসের শেষে সপ্তাহে দেখা যাচ্ছে, তা বেড়ে হয়েছে ২৪ শতাংশ। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সেপ্টেম্বরের প্রথম ৭ দিনে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান ১১ জন। আর শেষ ৭ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩০ জন। ডেঙ্গু সংক্রমণের সঙ্গে বাড়ছে এডিস মশার বিস্তারও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে করা গবেষণায় দেখা যায়, এবার সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় এডিস মশা বেড়ে গেছে ১৫ শতাংশের বেশি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও সাভারের বিভিন্ন এলাকায় জরিপ করে তিনি এমন তথ্য পেয়েছেন। গত বছর দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়। সে বছর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সেপ্টেম্বর মাসে। ওই মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন। মারা গিয়েছিলেন ৩৯৬ জন। এবার যেসব কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধি এ বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও মার্চ থেকে তা কমে আসে, অন্তত আগের বছরের তুলনায়। তবে আগস্ট মাস থেকে আবার বাড়তে থাকে সংক্রমণের সংখ্যা। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের কারণে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কাজগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আন্দোলনের সময় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌরসভা কার্যালয়ে ভাঙচুর হয়। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। জনস্বাস্থ্যবিদ আবুল জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রতিনিধিদের এভাবে ঢালাও অপসারণের ফলে ডেঙ্গু রোধের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। এর ফলে মশা নির্মূল করার সব কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নজরের বাইরে চলে গেছে। এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। কিন্তু এবার জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। যদিও আগস্টে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের একটি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেই সমন্বয় হয়নি। প্রতিবছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা তিন দফায় ডেঙ্গুর লার্ভা জরিপ করে তা স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বর্ষাপূর্ব জরিপ হয়েছিল। কিন্তু বর্ষা ও বর্ষাপরবর্তী জরিপ হয়নি। গত বছর অক্টোবরের মধ্যে এই দুই পর্যায়ের জরিপ সম্পন্ন হয়েছিল। এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। কিন্তু এবার জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। যদিও আগস্টে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার শুন্য দশমিক ৫৩। এটা গত বছর ছিল শূন্য দশমিক ৫২। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক শেখ দাউদ আদনান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয়টি উদ্বেগের। এর নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি।’ অক্টোবর নিয়ে ভয় কেন ডেঙ্গু বর্ষাকালের রোগ। ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়ে আগস্ট মাসে। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে সেই চিত্রের কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। এখন ডেঙ্গু রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যা সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে হচ্ছে। ২০২২ সালে দেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় অক্টোবর মাসে। এবারও এ মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কার কারণ আগের মাসগুলোর অস্বাভাবিক বৃষ্টি। যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রভাষক নাজমুল হোসেন ডেঙ্গু নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কোনো মাসে প্রতি সেন্টিমিটার বেশি বৃষ্টিপাতের জন্য পরবর্তী মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৮ শতাংশ এবং তারপর পরবর্তী মাসে ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে, রোগীর সংখ্যা সাত হাজারের বেশি। এরপরই আছে চট্টগ্রাম বিভাগ, রোগী সাড়ে ছয় হাজারের বেশি। ঢাকার বাইরে সংক্রমণরোধে মাঠপর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম। এক মাসেই মুগদায় ৩ হাজারের বেশি রোগী রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ২৭০ জন। এর মধ্যে রয়েছে ৮৩৯ শিশু। সেপ্টেম্বরে মারা গেছেন ৮ জন। এর মধ্যে শিশু একজন। গত রোববার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৫ শিশু ভর্তি হয়েছে। এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুগদা হাসপাতালে ৮ হাজার ৮১০ জন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩২ জন মারা গেছেন। ডেঙ্গু রোগীর ভিড় মুগদা হাসপাতালে তুলনামূলক বেশি। আশপাশের রোগী ছাড়া দূর থেকেও রোগী আসছেন। মো. হাসানকে গতকাল ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়েছেন। পেশায় গাড়িচালক হাসানের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। মুগদায় কেন এসেছেন, জানতে চাইলে বলেন, তাঁর এলাকার আরও অনেকেই এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাই তিনিও এখানে এসেছেন। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, হাসপাতালের ১২ তলাও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সরকার থেকে মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রোগী বেশি হলে সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে বলে জানান এই চিকিৎসক। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সাধারণ লক্ষণগুলোর পাশাপাশি শক সিনড্রোম বেশি। তবে গত বছরের চেয়ে এবার রোগীর সংখ্যা কম। জুলাই থেকে রোগী বেড়েছে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানা যায়, সারা দেশে শেষ ২৪ ঘণ্টায় (রোববার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৫২ জন। সাধারণ লক্ষণগুলোর পাশাপাশি শক সিনড্রোম বেশি। তবে গত বছরের চেয়ে এবার রোগীর সংখ্যা কম। জুলাই থেকে রোগী বেড়েছে বেশি। মুগদা হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |