গজলডোবা বাঁধ দিয়ে পানি ছেড়েছে ভারত, বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়বে
নতুন সময় ডেস্ক
|
বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় তিস্তা নদীর পানি এমনিতেই বাড়ছে। এর মাঝে গতকাল দুই দফায় গজলডোবা বাঁধ দিয়ে প্রায় ১১ হাজার কিউমেক পানি ছেড়েছে ভারত। তবে বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, এই বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আগে থেকে তাদের কিছু জানা ছিল না। কিউমেক মানে হলো কোন নদী বা জলধারা থেকে প্রতি সেকেন্ডে কত ঘনমিটার পানি ছাড়া হয়েছে, তার হিসাবের একক। প্রতি সেকেন্ডে এক ঘনফুট পানি বা প্রায় ২৮.৩১ লিটার পানি ছাড়া হলে তাকে এক কিউসেক বলা হয়ে থাকে। আর ৩৫.৩১ কিউসেকে এক কিউমেক হয়। কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ভারত যে বাড়তি পানি ছেড়েছে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছে অফিশিয়াল কোনো খবর নেই। তাদের জানা গত অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার দোমহনীতে গতকাল শনিবার তিস্তার প্রবাহ পাওয়া গেছে দুই হাজার ২৬৭ কিউমেক, যা বছরের এই সময়ে 'স্বাভাবিক ঘটনা'। গজলডোবা বাঁধ খোলার কারণ? তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদীর বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের অংশেই ব্যারেজ বা বাঁধ আছে। বাংলাদেশ অংশের তিস্তা নদীর বাঁধ রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলায়, নাম তিস্তা ব্যারেজ। ভারতে তিস্তা নদীর ওপর একাধিক বাঁধ আছে। তার মাঝে একটি হল জলপাইগুড়ি’র গজলডোবা বাঁধ। গজলডোবা’র তিস্তা বাঁধ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল শুক্রবার ভারতীয় সময় রাত আটটায় প্রায় ছয় হাজার ও তারপর রাত সাড়ে ১২টায় আরও একবার চার হাজার ৭০০ কিউমেকেরও বেশি পানি ছাড়া হয়েছে। এরপরে আর নতুন করে পানি ছাড়ার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, তিস্তা নদীর বাঁধের কিছু কিছু গেট বা দ্বার বছরের একটা বড় সময় জুড়ে খোলাই থাকে। তবে যখন কোনও কারণে পানির পরিমাণ বাঁধের ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সেই বাড়তি পানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বাঁধের আরও গেট একযোগে খুলে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। গজলডোবা বাঁধ দিয়ে হঠাৎ করে এত বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সেচ দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের মতো ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায়ও গত তিনদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে তিস্তা নদীর ভারতের অংশের বেশ কয়েকটি জায়গায় পানি বিপদসীমা ছাড়িয়ে এবং বাঁধের পানি ধারণক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ওই পানি বের করার জন্য এক পর্যায়ে আরও গেট খুলতে হয়েছে। বিবিসি সংবাদদাতা কলকাতা থেকে জানিয়েছেন, গতকাল শুক্রবারই কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত নদীর দুই তীরেই লাল সতর্কতা জারি হয়েছিলো। আজ শনিবার মাঝরাতে মেখলিগঞ্জের উজান অঞ্চলেও লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তিস্তা অববাহিকায় পানির স্তর বাড়তে থাকায় গতকাল রাত থেকে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের জেলা প্রশাসন নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে দিতে শুরু করেছে। ভারতীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান দপ্তর আজ শনিবার সকালে জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় কালিম্পং জেলায় ১৩০ মিলিমিটার ও জলপাইগুড়ি জেলায় ১৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ওই দুই জেলায় আজও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে তারা। বাংলাদেশ এটিকে যেভাবে দেখছে প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে যে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতো না বাংলাদেশ। তবে সরদার উদয় রায়হানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, মে থেকে শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত, এই সময়ে বাঁধ সাধারণত খোলাই থাকে। মূলত বর্ষাকালে বাঁধ বন্ধ রাখা হয় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে বাঁধ, সেটিও এই সময়ে খোলাই থাকে। এখন যেহেতু বর্ষাকাল, তাই সেচেরও দরকার নাই। বাঁধ দেওয়ার মূল কারণ তো সেচই। তাছাড়া এ সময় পানির ফুল-ফ্লো থাকে। তাই ব্যারেজের ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে সবসময়ই খোলা রাখা হয়। বাঁধের গেট যেহেতু বর্ষাকালে খোলাই থাকে, তাই আলাদা করে এ ব্যাপারে সতর্কতা জারি করা হয় না। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে ড্যাম বা বাঁধ দেওয়া হয়, তা থেকে পানি ছাড়ার আগে জানাতে হয়। 'কারণ ড্যামের বিষয়টা ভিন্ন ড্যামে পানির ধারণক্ষমতা বেশি। এখানে পানি জমিয়ে রাখে, পরে রিলিজ করে। ব্যারেজের ধারণক্ষমতা ড্যামের চেয়ে অনেক কম,' তিনি আরও বলেন। সরদার উদয় রায়হানের মতে, বাংলাদেশ যে দুই হাজার ২৬৭ কিউমেক পানি প্রবাহের কথা জানে, তা এই মৌসুমের স্বাভাবিক প্রবাহ। কিন্তু যদি সত্যিই ওই প্রায় ১১ হাজার কিউমেক পরিমাণ পানি গতকাল ছেড়ে থাকে ভারত, তাহলে এতক্ষণে অনেক বড় বন্যা হয়ে যাওয়ার কথা বাংলাদেশে। সত্যিই বন্যা হবে কি? বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সরদার উদয় রায়হান বিবিসি বাংলাকে জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টা তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তাই তিস্তা অববাহিকায় 'সাধারণ বন্যা' দেখা দিতে পারে। 'তবে খুব ভয়াবহ কিছু হবে না। তবে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু সেটা মারাত্মক কিছু না। তিস্তা নদীর অববাহিকা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট- এই পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি আছে,' বলছিলেন মি. রায়হান। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর 'তিন দিন আগে থেকেই' ভারী বৃষ্টিপাতের কথা বলছে। তার ওপর ভিত্তি করে তিস্তা নদীতে আরও চারদিন আগেই এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিলো। এই পানি কমবে কবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টা, মানে সকাল বা দুপুরের পর। তবে তিস্তা নদীর পানি ক্রমশ বাড়তে থাকলেও তা এখনো 'বিপদসীমা অতিক্রম করেনি'। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, তিস্তা নদীতে গত তিন দিনে গড়ে এক মিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ডালিয়া পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার বিপদসীমার নিচে দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩০ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি বৃদ্ধি পেতে পারে। যদিও ডালিয়া পয়েন্টের পানি আজ রাত ৯টার পর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করতে পারে। এদিকে, আজ সকালে গুগল ম্যাপেও দেখা গেছে যে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। তবে রংপুর বিভাগের তিস্তা নদী না শুধু, ভারী বৃষ্টির কারণে 'উজান থেকে প্রবাহ আসায়' প্রায় সকল নদীরই পানি সমতল বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের আজ দুপুরের পূর্বাভাসে। বলা হচ্ছে, রংপুরের অন্যান্য প্রধান নদী- করতোয়া, আত্রাই, টাঙ্গন, পূণর্ভবা, ইছামতি, যমুনা, ঘাঘট ও যমুনেশ্বরী নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সেগুলোও বিপদসীমার নিচে।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |