‘লাড্ডু’ নিয়ে ভারতে রাজনৈতিক ঝড়!
নতুন সময় ডেস্ক
|
ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি ‘লাড্ডু’ নিয়ে সম্প্রতি রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গত সপ্তাহে দেশটির অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নায়ডুর এক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ বিতর্কের শুরু, যা সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। নায়ডু তার বক্তব্যে জানান, রাজ্যের বিখ্যাত তিরুপতি মন্দিরে প্রতিদিন দেবতার উদ্দেশ্যে যেসব লাড্ডু নিবেদন করা হয় এবং তারপর ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, সেগুলোতে পশু এবং সবজির চর্বি মেশানো হয়। তিনি বলেন, ‘যে ঘি (পরিষ্কার করা মাখন) মিষ্টিগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ‘গরুর চর্বি, মাছের তেল এবং অন্যান্য অপদ্রব্য’ মিশ্রিত থাকে। ভারতে মন্দিরের প্রসাদ সাধারণত নিরামিষ হয়।’ প্রাথমিকভাবে বিষয়টিকে খাদ্যে ভেজাল হিসেবে মনে করা হলেও নায়ডুর বক্তব্যের পর থেকেই এটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে উঠেছে, বড় রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এবং অন্যান্য মন্দিরগুলোকে তাদের মিষ্টিগুলোর ‘শুদ্ধতা’ পরীক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপতি মন্দির হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র স্থান। হিন্দু দেবতা শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর, যিনি সাধারণত বালাজি নামে পরিচিত, তার জন্য নিবেদিত এই মন্দিরটির সম্পত্তির মূল্য কোটি কোটি ডলার এবং এটি প্রতি বছর ভারত ও বিদেশ থেকে প্রায় ২৪ মিলিয়ন ভক্তকে আকৃষ্ট করে। বিখ্যাত তিরুপতি লাড্ডুগুলো ছাতু, চিনি, কাঠবাদাম, কিসমিস ও এলাচ দিয়ে তৈরি এবং ‘শুদ্ধ গরুর ঘি’ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়, যা ভক্তদের কাছে দেবতার আশীর্বাদ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিন মন্দিরের রান্নাঘরে ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি লাড্ডু প্রস্তুত করা হয়। তাই, নায়ডুর কথাগুলো ভক্তদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে এবং অনেক ধর্মীয় নেতারা কর্তৃপক্ষের প্রতি মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘যেসব মন্দিরে কোটি কোটি ভক্ত আসেন, সেসব স্থানে যাতে এত বড় পাপের পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত,’ সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে বলেছেন পুরোহিত রামানা দীক্ষিতুলু। আরেকজন প্রখ্যাত পুরোহিত স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সারস্বতী বলেছেন, ‘এটি কোটি কোটি হিন্দুর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আস্থার ওপর একটি আক্রমণ।’ ‘এটি একটি সংগঠিত অপরাধ এবং হিন্দুদের জন্য একটি বড় বিশ্বাসঘাতকতা। এটি তদন্ত করা উচিত এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত,’ তিনি একটি সংবাদ চ্যানেলে বলেছেন। এই বিষয়টি রাজনৈতিক বৈরিতা হিসেবেও পরিণত হয়েছে, যখন নায়ডু তার প্রতিপক্ষ ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএস জগন মোহন রেড্ডিকে এ ‘অপমান’ এর জন্য দায়ী করেছেন। জুনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করা নায়ডু অভিযোগ করেছেন, অশুদ্ধ লাড্ডুগুলো রেড্ডির শাসনকালে ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। মন্দিরের বোর্ডটি রাজ্য সরকার পরিচালিত এবং এটি মন্দির পরিচালনার প্রধানকে নিযুক্ত করে। নায়ডু বলেন, তিনি ঘি সরবরাহকারী পরিবর্তন করেছেন এবং এই বিষয়টির তদন্তের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছেন, যার নেতৃত্বে থাকবেন একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। রেড্ডি উত্তেজিত হয়ে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং নায়ডুর বিরুদ্ধে নোংরা রাজনীতির অভিযোগ তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাঠানো একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন, নায়ডুকে ‘কঠোর শাসন’ করতে হবে। নায়ডু মোদির কেন্দ্রীয় সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। রেড্ডি লিখেছেন, ‘নায়ডু একজন প্যাথোলজিক্যাল ও অভ্যাসগত মিথ্যাবাদী,’ যিনি মন্দির ট্রাস্টের ভাবমূর্তি বিকৃত করছেন মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে। তিনি বলেন, যদিও মন্দিরে ঘি'র পবিত্রতা পরীক্ষার জন্য কোনো ল্যাব নেই, তবে এর কর্মকর্তারা চেহারা ও গন্ধের মাধ্যমে অশুদ্ধতা সনাক্ত করার অভিজ্ঞতা রাখেন এবং তার সরকারের সময়ে ও নায়ডুর দলের শাসনের সময় ঘি ট্যাঙ্কারগুলো সরবরাহকারীদের কাছে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। রেড্ডির দল রাজ্যের বিভিন্ন মন্দিরে ধর্মীয় আচার-আচরণে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, তারা ‘পাপের হাত থেকে’ নিজেদেরকে শোধরাতে চান; যা (পাপ) তাদের মতে, নায়ডু লাড্ডুগুলোর বিষয়ে অভিযোগ করার ফলে ঘটেছে। এদিকে, তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানমস (টিটিডি), যা প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো এই মন্দির পরিচালনা করে, পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছে। একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা পাঁচটি কোম্পানির মাধ্যমে ঘি সংগ্রহ করছে। তীর্থযাত্রী ও লাড্ডু প্রস্তুতকারীদের অভিযোগের পর তারা নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পান, তামিলনাড়ুর এআর ডেইরির চারটি ট্যাঙ্কার মানের দিক থেকে উচ্চমানের ছিল। এআর ডেইরি ১৯৯৮ সাল থেকে ঘি উৎপাদন করছে এবং দাবি করেছে, তারা তাদের দুধের ওপর ১০২টি মান পরীক্ষা চালিয়েছে। এসব অভিযোগকে ‘অবাস্তব’ বলে অভিহিত করে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এসব অভিযোগ তাদের ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর। তারা দাবি করেছে, মাছের তেল যোগ করার অভিযোগ ‘বেকার’ কারণ মাছের তেল ঘির চেয়ে বেশি দামী এবং কোনো ধরণের মিশ্রণ হলে তার গন্ধ থেকে তা স্পষ্ট হবে। দেবতাদের ও মানুষের জন্য ব্যবহৃত লাড্ডুর শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে, মন্দিরের পুরোহিতরা সোমবার চার ঘণ্টার ‘শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান’ করেছেন, যেখানে তারা রান্নাঘর এবং লাড্ডুর ওপর পবিত্র জল ছিটিয়েছেন। তবে, এই বিতর্ক এখনও খবরের শিরোনাম জুড়ে রয়েছে। জনপ্রিয় অভিনেতা এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যান এই মিশ্রণকে ‘হিন্দু ধর্মের ওপর আক্রমণ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তিনি ১১ দিনের পাপ মোচনের অনুষ্ঠান করছেন, যা তিনি ‘মহান অবিচার’ বলে মনে করছেন। একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের সদস্যরা রেড্ডির বাড়ির সামনে প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান দেন এবং তার গেট ও দেয়াল জাফরান রঙে রাঙিয়ে দেন, যা হিন্দু পুরোহিতদের সঙ্গে যুক্ত এবং বিজেপির রঙও। অন্যান্য রাজ্যও তাদের হিন্দু মন্দিরের মিষ্টিগুলি পরীক্ষা করছে, যেমন মথুরার বিখ্যাত কৃষ্ণ মন্দির এবং ওড়িশার জগন্নাথ মন্দির। এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচিত হয়েছে, যেখানে #TirupatiLaddu এবং #TirupatiLadduControversy এর মতো হ্যাশট্যাগগুলো দিনকে দিন ট্রেন্ডিং হয়ে উঠেছে। অনেক ব্যবহারকারী এটি হিন্দু বিশ্বাসের ওপর আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে, কিছু ক্ষোভের উৎসকে একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা হিসেবে মনে করা হচ্ছে; কারণ অনেক অ্যাকাউন্ট হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সমর্থনে রেড্ডির মুসলিম টুপি পরা ছবিগুলো শেয়ার করেছে এবং তাকে ‘অ্যান্টি-হিন্দু’ হিসেবে অভিহিত করেছে। একটি টুইটে উল্লেখ করা হয়েছে, একজন ব্যবহারকারীর মা তিরুপতি লাড্ডু খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পরেন, যা ইঙ্গিত করে লাড্ডুতে কিছু সমস্যা ছিল। সূত্র: বিবিসি
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |