সহকর্মীকে বাঁচাতে ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেল আলিফের
মোঃ মামুন অর-রশীদ, ঠাকুরগাঁও
|
জীবনের মায়া ত্যাগ করে সহকর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন ঠাকুরগাঁয়ের ছেলে মোন্তাকিম আলিফ (২৫) । বাংলা সিনেমার নায়কের চরিত্রকে হার মানিয়ে মেয়ে সহকর্মীর প্রাণ বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত সহকর্মীকে সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেও নিজেই রক্ষা হয়নি। সন্ত্রাসীদের দেশীয় অস্ত্রের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় আলিফের। তবে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হলেও মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন এই যুবক। মোন্তাকিম আলিফের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল ইউনিয়নের দোগাছি মধুপুর গ্রামে। থাকেন জেলা শহরের টিকাপাড়ায়। তিনি ২০১৬ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতেও চাকরি করতেন। জানা গেছে, অফিসের নাইট শিফট শেষ করে ভোররাতে আলিফ তার সহকর্মীকে (নারী) নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। তারা কুড়িল ফ্লাইওভারের সামনে এলে নেশাগ্রস্ত তিনজন বখাটের কবলে পড়েন। এসময় মোন্তাকিম আলিফ মেয়েটিকে ছিনতাইকারীদের সামনে থেকে সরিয়ে দেন। পরে তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি এবং মারধরও করেন আলিফ। এক পর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আলিফকে আঘাত করে পালিয়ে যায় বখাটেরা। তাৎক্ষণিক হাসপাতালের নিলে প্রচণ্ড রক্তক্ষণে তার মৃত্যু হয়। আলিফের এমন মৃত্যুতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ এলাকাবাসী শোকে পাথর। তার বাড়িতে ভিড় করছে আত্মীয়স্বজনরা। তার বাবা জুলফিকার আলী ও মা কোহিনুর বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা। উপস্থিত সবার চোখে পানি। আলিফের মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, 'আমার কলিজার ধনকে আনে দেও। আমার ধনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। আহা রে ধনটা কই গেল। ভালো করে লেখাপড়া করবে, সেজন্য ঢাকা শহরে ভালো কলেজ ভর্তি করালাম। মাসে মাসে এখন আমি কাকে টাকা পাঠাব। এখন আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব। আমাক একা করে এভাবে চলে যাবি। আমাকে সঙ্গে করে কেনে নিয়ে গেলি না।' এক মেয়েকে বাঁচাতে আলিফের এমন মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী আখ্যা দিচ্ছেন। আলিফের বন্ধু মুনিজা হোসেন প্রিথিলা তার ফেসবুকে লিখেছেন, 'একটা মানুষ নিজের জীবনের শেষটুকু দিয়ে একটা মেয়ের জীবন বাঁচিয়ে গেলো। আসলে কত বড় মন হলে এবং কতটুকু ভালো মানুষ হলে একজন নিজের জীবনের শেষ সময়েও আরেক জনের জীবন বাঁচায়? কেউ বলতে পারবেন? অনেক রাগ ছিলো আমার প্রতি তোর। মাফ করে দিস আমাকে আলিফ।' শাহারিয়ার জাকির রিম্পু লিখেন, 'আলিফের জন্য আমরা গর্বিত। ওর বাবা-মাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। প্রিয় সন্তান আলিফকে হারানোর অভাব কেউ কোনো দিনই ওর বাবা-মাকে পূরণ করে দিতে পারবে না। কিন্তু আলিফকে নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। সেটি হলো, আমাদের তরুণ, যুবক সমাজ এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে, পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ায়নি। আমরা আশান্বিত হতেই পারি, সমাজে এখনো আলিফের মতো যুবকরা আছে, যারা নিজের সমূহ সর্বনাশ হতে পারে জেনেও মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন নারীকে রাক্ষুসদের হাত থেকে রক্ষ করে।' শ্রাবণী বর্মণ নামে আরেক বন্ধু লিখেন, 'সকাল সকাল এই নিউজটা পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ওর বাসা পার হয়েই আমার বাসা যেতে হতো, সেই সুবাদে আলিফকে রাস্তায় প্রায়শই দেখতাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন চাপতে। আলিফ শুধু ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতেই নিহত হয়নি, একজন মেয়েকে তাদের হাত থেকে সর্বোচ্চ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে।' আলিফের আরেক বন্ধু লিখেছেন, 'আহ জীবন! আমার সহপাঠী, ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শুরু থেকে যার সাথে ওঠাবসা, ওরে আজ হারাইলাম; অন্যকে বাঁচাইতে গিয়ে সে নিজে চলে গেল না ফেরার দেশে। আমি বাকরুদ্ধ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক, ভাই।' মানসুরুল হক (বাবু) লিখেন, 'আলিফের মৃত্যুতে একটি মেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেলেও তাঁর মা-বাবা কখনো ভুলতে পারবেন না ছেলের এভাবে চলে যাওয়া। তবে মহাকাল সবকিছুকে ধ্বংস করে দিলেও কিছু কর্ম, ত্যাগ, সৃষ্টি কখনো বিলীন হয় না। তেমনি মহৎ কোনো কাজের মাধ্যমে মৃত্যুর পরও অন্যদের মনে অমর হয়ে থাকেন কিছু কিছু মানুষ। মোন্তাকিম আলিফও এমনই একজন।' |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |