আ.লীগ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ১৪ দলের নেতাদের
আ.লীগ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ১৪ দলের নেতাদের
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং বর্তমান অবস্থা নিয়ন্ত্রণে করণীয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন ১৪ দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এই জোটের নেতারা জোট নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কিছু প্রস্তাব-সুপারিশও করেছেন বৈঠকে। এর মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও কারফিউ আরও একমাস রাখা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রাখার পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও মাঠে রাখার মতো বিষয় রয়েছে।
এছাড়া ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনের কারণ পর্যালোচনা, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বুঝেশুনে আচরণ করা, প্রশাসানকে সতর্কভাবে কাজ করা এবং শিক্ষাঙ্গনে দ্রুত স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, সামনের দিনে সরকারবিরোধী সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবিলায় করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
সোমবার (২৯ জুলাই) সন্ধ্যায় গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের জরুরি বৈঠক হয়। সেখানে ১৪ দলের নেতারা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের মূল্যায়ন তুলে ধরেন শেখ হাসিনার কাছে। এ সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের কারণে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয় বলে দাবি করেন নেতারা। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের অতিকথন এবং পরিস্থিতি বুঝে সতর্কভাবে বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে উদাসীনতা ছিল কিনা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কৌশল নিয়েও কথা বলেছেন তারা।
রুদ্ধধার এ বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক সূত্র জানায়, ১৪ দলের নেতাদের প্রস্তাবে সর্বসম্মতভাবে জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে বলে জানানো হয়েছে।
এছাড়া কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতি আপাত অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসলেও বিএনপি, জামায়াত, শিবির ফের অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করতে পারে, সেই আশঙ্কার কথাও বলেছেন অনেক নেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদেও সভাপতি হাসানুল হক ইনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ শিক্ষাঙ্গণে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা। সেজন্য যা যা করার তাই করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন সতর্কতার সঙ্গে কাজ করে, তাদের সেভাবে ব্যবহার করা হয়, সেই আহ্বান জানানো হয়েছে।
সূত্রমতে, কোটা আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য-বিবৃতি উদ্ভুত পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে বলে অনেকে মনে করেন। তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলেও দাবি ১৪ দলের একাধিক শীর্ষ নেতার। তারা বৈঠকে এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।
হাসানুল হক ইনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যর্থতা, ভুল-ত্রুটি, বাড়তি কাজ তদন্ত করে দেখা উচিত এবং দোষিদের শায়েস্তা করা উচিত। সংগঠনের (আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ) মধ্যে যারা বাড়াবাড়ি করেছে, সেটিও দেখা উচিত এবং ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কেউ অতিকথন করলেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এসব বিষয় আমরা বৈঠকে বলেছি।
বৈঠক সূত্র জানায়, কারফিউ আরও ১৫ দিন থেকে এক মাস অব্যাহত রাখতে সুপারিশ করেন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি। এই সময়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখারও পরামর্শ দেন তিনি।
বৈঠকে জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, যেকোনও মূল্যে শিক্ষাঙ্গণে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে শুরু হতে পারে। দ্বিতীয়ত স্কুল খুলে দেওয়া যেতে পারে। নিজেদের আরও সংগঠিত হতে হবে। ছাত্রলীগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। সহিংসতা এড়াতে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা এবং কাল-পরশুর মধ্যে তা কার্যকর করা।
বৈঠকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, দলের ব্যর্থতা, প্রশাসনিক ভুলত্রুটির কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। পুলিশের ব্যর্থতা-ছাত্রলীগের ব্যর্থতাসহ যা আছে তার সবই তুলে ধরেন তিনি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, তার বক্তব্য-বিবৃতি পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করেছে।
এসময় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও ওবায়দুল কাদের ও পুলিশি হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা করেন।
১৪ দলের প্রায় সব নেতাই জনগণকে কীভাবে স্বস্তি ও আস্থায় আনা যায় সে বিষয়ে কথা বলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে পুলিশের তৎপরতার ওপর বিশেষ নজর রাখতে বলা হয়েছে। সঠিক তথ্য নিয়ে গ্রেফতার করার দাবি করা হয়েছে। হয়রানি যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথা বলা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা
সত্যিকার অর্থে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বন্ধ করতে হলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে বলে দাবি করেন ১৪ দলীয় জোট নেতারা। তারা বলেন, জনগণকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সচেতন করা, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ থেকে রক্ষা করতে সবাইকে নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। যৌথভাবে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত কাঠামো বিস্তৃত করতে হবে। ১৪ দলসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সবাইকে নিয়ে কাঠামো তৈরি করা এবং সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এগুলোতে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। সিরিয়াসলি মোকাবিলা করা হবে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, নিবন্ধন বাতিল করার সময়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে দেশে এতগুলো লাশ পড়তো না।
পরে জামায়াত নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা সবাই রাজি থাকলে আমি এ সিদ্ধান্ত এখনই নেবো।
এসময় নবিুল বশর মাইজভান্ডারি বলেন, আপা সত্যি সত্যি নেবেন? বাইরে বলা যাবে?
শেখ হাসিনা বলেন, এ সিদ্ধান্ত এখনই নেবো।
কোনও অবস্থাতেই এখন কারফিউ তোলা যাবে না দাবি করে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বলেন, পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। জামায়ত-শিবির ও বিএনপি এখনও ঘরে ফেরেনি। কারফিউ তোলা হলেও সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখন মাঠ থেকে তোলা যাবে না। আর ১৫ দিন বা কমপক্ষে এক মাস রাখতে হবে মাঠে।
পরে প্রধানমন্ত্রী এতে সম্মতি জানান।
বৈঠকে ১৪ দল নেতারা আরও বলেন, পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেছে বলে মনে করেন না তারা। আপাতত শান্ত মনে হলেও সংকট ঘণীভূত হতে পারে। তাই জনগণের আস্থা তৈরি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে।
ডিবি হারুনের কর্মকাণ্ড ‘ডিবি অফিসে যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাবেন, তারপর খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না’ বলে সোমবার এক রিট শুনানির সময় মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
কোটা আন্দোলনের সমন্বকারীসহ বিভিন্ন জনকে নিয়ে খাবার খাচ্ছেন ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, এরকম ছবি ও ভিডিও প্রায়ই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে। উচ্চ আদালত ডিবি হারুনের এসব ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে যে মূল্যায়ন দিয়েছেন সে বিষয়টি তুলে ধরে নজিবুল বশর বলেন, এটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ডিবিতে যে সমন্বয়কদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে এটি ঠিক হয়নি।
১৪ দল থেকে ডিবির এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও বিশেষ করে ডিবি প্রধানের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সমালোচনা করা হয়। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিবির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাতেই কথা বলবেন।
সংবাদ সম্মেলনে নেতাদের বক্তব্য গভা শেষে গণভবনের গেটে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৪ দলের এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর অপরাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য। ১৪ দলীয় জোটের নেতারা মনে করেন, বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল, শিবির তাদের দোসর উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নস্যাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) সভাপতি হাসানুল হক সাংবদিকদের বলেন, আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ এখনও বন্ধ করেনি। তাই মনে করি বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারা, গণতান্ত্রিক ধারা, রাজনীতিকে রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশের সন্ত্রাসী, জঙ্গি, স্বশস্ত্র গোষ্ঠীর রাজনীতি ধ্বংস করার লক্ষ্যে তা নিষিদ্ধ করা দরকার। আজ ১৪ দলের সভা থেকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জামায়াত-শিবিরকে সংগঠনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকার নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৪ দল মনে করে আর সময়ক্ষেপণ না করে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা আশা করি প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। নিশ্চয়ই এক-দুই দিনের মধ্যেই এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাব।
বাংলাদেশের সাম্যবাদি দলের সভাপতি দিলীপ বড়ুয়া বলেন, আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা। বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেটা ঐতিহাসিক এবং জাতিকে বর্তমান ক্রান্তিকাল থেকে উত্তোরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।