তিন প্রশ্ন নিয়ে ডিবিতে সোহেল তাজ, বললেন ‘আর একটি গুলিও নয়’
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
তিনটি প্রশ্ন নিয়ে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ থাকা কোটা আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজীম আহমেদ সোহেল তাজ।শিক্ষার্থীদের যেন আর কোনো গুলি করা না হয়, সেই দাবিও জানিয়েছেন তিনি। সোমবার বিকাল বিকাল ৫টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ে যান রাজনীতি থেকে দূরে থাকা সোহেল তাজ। সোয়া ৬টার দিকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডিবির ফটকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তবে গোয়েন্দা কার্যালয়ে এক ঘণ্টা অবস্থান করলেও সেখানে থাকা কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। শুক্রবার দুপুরে ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে কোটা আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে আনা হয়। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা না হলেও রাতে হারুন ও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার’ কারণে তাদেরকে নিয়ে আসা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেওয়া হয়। রোববার নেওয়া হয় নুসরাত তাবাসসুমকে। রোববার রাতে ও সোমবার এই সমন্বয়কদের সঙ্গে দেখা করেছেন তাদের স্বজনরা। বের হয়ে বলেছেন, তারা ভালো আছে। আগের দিন আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করে যে ভিডিও বার্তা দেওয়া হয়েছিল, সেটি স্বেচ্ছায় দেওয়ার কথাও বলেছেন তারা। কোন সেই প্রশ্ন সাংবাদিকদেরকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন “আমি ডিবি প্রধানের কাছে তিনটা প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলাম। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল ‘এই ছয়জন সমন্বয়কারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নাকি সেইফ কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে?’ “দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘যদি তারা গ্রেপ্তার হয়ে থাকেন তাহলে আমার কোনো প্রশ্ন নেই, দাবি নেই। তারা যদি সেইফ কাস্টডিতে থাকে তাহলে তাদের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। “আমার তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, তাদেরকে কখন সেইফ কাস্টডি থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।” কী বললেন হারুন সোহেল তাজ জানান, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ তাকে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, এই ছয় সমন্বয়কারী ‘তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন’, তাই তাদেরকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। হারুনকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তখন প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনারা কীভাবে বুঝলেন যে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারা কী আপনাদের জানিয়েছিল অথবা রিকোয়েস্ট করেছিল?’ সোহেল তাজের ভাষ্য, হারুন তাকে বলেছেন, সমন্বয়করা ডিবিকে কিছু জানায়নি। ডিবি বিষয়টি বুঝতে পারে ‘নিজস্ব মনিটরিং থেকে’। “যেহেতু তারা সেইফ কাস্টডিতে আছে তাই আমি অনুরোধ করলাম আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই”, বলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে এই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তাকে বলা হয়েছে, “দেখা করতে চাইলে ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ অনুমতি লাগবে।” সমন্বয়কদের মুক্তির দিনক্ষণ নিয়ে প্রশ্নে সোহেল তাজকে বলা হয়েছে, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন নির্দেশনা দেবেন, তখনই তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে।” সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমার জানামতে একজন নাগরিক যদি রিকোয়েস্ট করে, তাহলে তাকে সেইফ কাস্টডিতে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রিকোয়েস্টের বাইরে যদি কাউকে সেইফ কাস্টডিতে নেওয়া হয়…(তিনি হেসে ফেলেন) তাহলে এটা কি সেইফ কাস্টডি না এটা অ্যারেস্ট? এটা ছিল আমার প্রশ্ন।” মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে সোহেল তাজ ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে গাজীপুর-৪ আসন (কাপাসিয়া) থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সোহেল তাজ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আবার জেতার পর তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হন। তবে অভিমান করে মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেন। সেই থেকে রাজনীতির বাইরে আছেন তিনি। বর্তমানে তিনি শরীর চর্চায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। তার আসনে এখন আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য বোন সিমিন হোসেন রিমি, যিনি এই মুহূর্তে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। ‘আর কোনো গুলি না’ ছাত্র আন্দোলনে প্রাণহানির তুলনায় সম্পদহানি ‘কিছুই না’ মন্তব্য করে সোহেল তাজ বলেন, “সম্পদের এই যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা তো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় করা হয়েছে। এগুলো জনগণের সম্পদ। এগুলো হয়ত ভবিষ্যতে আমরাই আবার গড়ে নেব। কিন্তু যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের একটি প্রাণও কি ফেরত পাব? এই প্রাণ কি ফিরে আসবে? “আমাদের মনে রাখতে হবে মুখ্য জিনিসটা কী। প্রাণের মূল্য কিন্তু কোটি কোটি কোটি টাকার থেকেও অনেক বেশি, এটা অমূল্য।” ভবিষ্যতে গুলি করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার অনুরোধ করে তিনি বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের, আমাদের সেনাবাহিনীকে, আমাদের ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোনদের বুকে যেন আরেকটা গুলি না যায়। “আপনারা বিরত থাকুন, এটা ঠিক না।” শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানান তিনি। দেশ নিয়ে উদ্বেগে গোয়েন্দা কার্যালয়ে কেন এসেছেন-এই প্রশ্নে সোহেল তাজ বলেন, “আমি প্রথমেই বলতে চাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজউদ্দীনের সন্তান আমি। আমি রাজনীতিবিদ হিসেবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি, দুইবার সংসদ সদস্য ছিলাম। এখন আমি একজন সাধারণ নাগরিক। “আমি আজকে ডিবি অফিসে এসেছি, কারণ আমি বাংলাদেশের সকল মানুষের মত এখন এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করছি।” তাজউদ্দিন পুত্র বলেন, “আমরা জানি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এমন একটি বাংলাদেশের জন্য যেখানে ন্যায়বিচার থাকবে, যেখানে মেধা দিয়েই যোগ্যতা যাচাই হবে। সেই সোনার বাংলাদেশে গরিব-ধনী সকলের জন্য মৌলিক অধিকার থাকবে, বাক স্বাধীনতা থাকবে, চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে। “আজকে আমি মনে করছি আমাদের সকলেরই এই অধিকারগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।” কোটা আন্দোলন নিয়ে দেশে একটি অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখানে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। নিরীহ ৫ বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে আট, ১০, ১৫ বা ১৬ বছরের বাচ্চা, ছাত্র, সাধারণ মানুষসহ অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। “এবং এটা আমাদের সবার মধ্যে ক্ষত তৈরি করেছে। আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই কারণে আজকে আমি ব্যক্তিগতভাবে এখানে এসেছি।” এই পরিস্থিতিতে সরকারের পদক্ষেপ ভুলে হয়েছি কি না- এই প্রশ্নে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এখানে একটা সমূহ সমাধান প্রয়োজন। তার জন্য প্রথম যে কাজটা করতে হবে প্রতিটি হত্যাকাণ্ড সুনির্দিষ্টভাবে তদন্ত করে করে বিচার করতে হবে এবং এগুলোর জন্য যারা দায়ী তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। “বিচার বহির্ভূত কোনো হত্যা করা যাবে না। তারপর আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতে হবে। আমাদের এই সমাধান রাজনৈতিকভাবে সবাইকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে।” শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “সামনে ভালো দিন আসবে, এজন্য এখন কষ্ট করতে হবে। আশা ছাড়া যাবে না, ডোন্ট লুজ হোপ। এই দেশটা তোমাদের সম্পদ, তোমাদেরই গড়তে হবে।”
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |