সুন্দর শান্ত প্রকৃতিকে অশান্ত করে তোলার নেপথ্যে প্রকৃতপক্ষে মানুষই দায়ী। গ্রামে কথিত আছে সাপের লেজে পাড়া না দিলে সাপ দংশন করে না। যদিও এটি একটি নিরীহ প্রাণী। সাপকে আক্রমণ করার সম্ভাব্যতা না থাকলে এটি কাউকে তাড়া করে না। কথাটির সঙ্গে গভীরভাবে মিল রয়েছে ‘পাহাড় ধসের’ ঘটনা। অর্থাৎ আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না পাহাড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবো, ততক্ষণ পাহাড় আমাদের রক্ষা করবে। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখবে। আর যখনই পাহাড়ের ক্ষতি করবো, তখনই এটি হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী।
সোমবারের আলোচিত ঘটনা হলো- সিলেটে পাহাড় ধরে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু।
জানা গেছে, সিলেট নগরের চামেলীবাগ এলাকায় পাহাড় ধসে ঘরের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে তাদের। এর আগে সকাল ৭টার দিকে চামেলীবাগ এলাকায় পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়েন ঐ পরিবারের ৭ জন। স্থানীয় লোকজন চারজনকে উদ্ধার করেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। পরে উদ্ধারকাজের সঙ্গে যুক্ত হয় সেনাবাহিনী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোর থেকেই সিলেটে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের চামেলীবাগ এলাকায় একটি পাহাড় ধস হয়।
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকাল ৬টা-৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
বৃষ্টির সময় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বৃষ্টি হলে পাহাড় ধস হবে এটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। মানুষের প্রাণহানি তো নয়ই। পাহাড় ধস কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি প্রকৃতপক্ষে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়।
পাহাড় ধস যেভাবে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়-
বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। শুধু কি গাছ, পাহাড় কেটে সমতল বানানো হয়েছে। গাছ না থাকায় মাটির কাঠামো দুর্বল হয়েছে। ফলে বৃষ্টি হলেই নামছে ধস।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরজুড়ে জুম চাষে পাহাড়ের গাছপালার সঙ্গে সবুজের সমারোহ ধ্বংস হচ্ছে। অপরদিকে, যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার্থে প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি, নতুন নতুন বাড়ি-ঘর নির্মাণে পাহাড়ি এলাকায় মাটি কাটা হয়। এসব কারণে পাহাড়ের গোড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগেও পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসের ঘটনা অস্বাভাবিক। এদিকে সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে।
পরিবেশবীদরা জানান, পাহাড়ের মাটির আকার বেলে, যা নরম আকৃতির। টানা বর্ষণ হলেই কোনো না কোনো স্থানে ছোট-খাটো ভূমি বা পাহাড় ধস হয়ে আসছে। এর মূল কারণ একটি পাহাড়ও অক্ষত নেই। কোনো না কোনোভাবে এর গোড়ায় আঘাত লাগছে।
তিন পার্বত্য জেলায় উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড়ের সমাহার। পাহাড় ঘেঁষেই মানুষের বসতি। পাহাড় ঘেঁষেই সড়ক নির্মিত। বর্ষা মৌসুম ও ঝড়বৃষ্টির সময় ছোট-খাটো দুর্যোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। পাহাড়ি ঢলে মানুষের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়। প্রাণহানিও ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়জুড়ে গাছপালা অর্থাৎ বনজ সম্পদের সমাহার। উঁচু-নিচু পাহাড়ের প্রাকৃতিক সেই বনজ সম্পদ একের পর এক উজাড় হচ্ছে জুম চাষসহ গাছ কাটার কারণে।
পাহাড় ধসে মৃত্যু কি কেবল নিছক সংখ্যা?
পাহাড় ধস নিয়ে প্রতিবছরই প্রশাসনের সভা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের তালিকা হালনাগাদ হয়, কিছুদিন পর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সতর্কতামূলক মাইকিং হয়। কিন্তু পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী খুব কম মানুষই এসবে কান দেয়। পরিণতিতে হারাতে হয় মূল্যবান প্রাণ।
এ নিয়ে কয়েকদিন সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় চলে, প্রশাসনের পক্ষে তদন্ত কমিটি হয়, ত্রাণ তৎপরতা চলে, চলে উচ্ছেদ অভিযান। তারপর মৃত মানুষগুলো নিছক সংখ্যায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে ফের ফিরে আসেন পাহাড়ের বেআইনি বাসিন্দারা।
পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস যে কারণে অনিয়ন্ত্রিত
পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস নিয়ন্ত্রিত হওয়ার বদলে বৃদ্ধির বড় কারণ আসলে প্রশাসনের ‘মৌসুমি’ তৎপরতা।
বছরজুড়ে বিভিন্ন পাহাড়ে যারা ঘরসংসার পেতেছেন, প্রায় ছিন্নমূল এসব মানুষ মাত্র কয়েক মাসের জন্য ‘নিরাপদ’ আশ্রয় কোথায় পাবে? এ ক্ষেত্রে প্রশ্নটি আরো গভীরের।
সেখানে বসবাসরতদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া না হয় গেল, ধসের যে মূল কারণ, সেই বিসবুজীকরণ ও পাহাড় কাটা বন্ধের কী হবে? কিছু পরিবারকে সরিয়ে কিছু প্রাণ নিশ্চয়ই রক্ষা পাবে; কিন্তু খোদ পাহাড়ের ‘প্রাণহানি’ তো ঠেকানো যাবে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে প্রথমেই নজর দেওয়া উচিত পাহাড়ে বসতি স্থাপন প্রক্রিয়ার দিকে। এসব বসতির পেছনে থাকেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবশালীরা। তারাই কখনো মাসোহারা তোলার জন্য বা কখনো প্রাথমিক দখল সম্পন্ন করতে ছিন্নমূল মানুষকে এনে বসতি গড়ে দেন। এই নেপথ্য খলনায়কদের আনতে হবে বিচারের আওতায়।
অন্যথায় বছর বছর উচ্ছেদ অভিযানের নামে কেবল উপরিকাঠামো মাজাঘঁষাই সার হবে। অন্যদিকে, বছরের পর বছর পাহাড় ধসের প্রাণঘাতী চক্র চলতেই থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, গাছপালার শেকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। এখন যেহেতু গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে এবং জুম চাষের ফলে সবুজ থাকছে না, ফলে পাহাড়ের বেলে মাটি ভারি বর্ষণের কারণে স্থির থাকতে ব্যর্থ হচ্ছে।
অপরদিকে, পাহাড়ি অঞ্চলে প্রতি বছর নতুন নতুন যে সড়ক নির্মিত হচ্ছে এবং জনবসতি বিস্তৃতি লাভ করছে এতেও পাহাড়ের গোড়ার মাটি কাটা হচ্ছে। ফলে পাহাড় প্রতিনিয়ত ভারসাম্য হারাচ্ছে।
দীর্ঘদিনের নির্বিচারে এ জাতীয় ঘটনার ফলে ভারি বর্ষণে পাহাড় ধস হচ্ছে বলে নিশ্চিত করা হচ্ছে।