কালো বোরকায় ঢাকা একজন নারী। শুধু মুখটুকু খোলা। তাঁর নাম উম্মে হুদাইফা। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সাবেক প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির বিধবা তিনি। ইরাকের রাজধানী বাগদাদের একটি কারাগারে বন্দী আছেন হুদাইফা। সেখানে নির্জন কোণে বসে বিবিসিকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এই নারী। জানিয়েছেন নিজের গল্প, স্বামী-সন্তান-সংসারের গল্প। উঠে এসেছে আইএসের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথাও।
হুদাইফা জানান, তিনি আবু বকর আল-বাগদাদির প্রথম স্ত্রী। যদিও দাবি করেছেন, স্বামী যে আইএসের প্রধান, সেটা তিনি জানতেন না। বলেন, ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে তিনি স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে সিরিয়ার রাকা শহরে বসবাস করতেন। তাঁর স্বামী বাড়িতে কম থাকতেন। বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতেন।
হুদাইফা বলেন, ‘২০০৭ সালের পর থেকে আমি মোবাইল ফোনের মতো কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করিনি। তখন বাসায় একটা টেলিভিশন ছিল। আমি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে সেটা চালু করতাম, দেখতাম। বিশেষ করে যখন আমার স্বামী বাসায় থাকতেন না, তখন দেখতাম।’
একদিন একজনকে বাড়িতে পাঠান হুদাইফার স্বামী। ওই ব্যক্তি এসে বলেন, দুই ছেলেকে নিয়ে যেতে বলেছেন আবু বকর আল-বাগদাদি। শিশু দুটিকে ইউফ্রেতিস নদীতে সাঁতার শেখানো হবে। নিয়ে যাওয়ার কদিন পর টেলিভিশনে একটি ফুটেজ দেখে চমকে ওঠেন হুদাইফা। তিনি দেখেন, ইরাকের উত্তরাঞ্চলের মসুলের আল-নুরি মসজিদ থেকে বক্তব্য দিচ্ছেন তাঁর স্বামী। সেখানে নিজেকে আইএস খিলাফতের প্রধান হিসেবে পরিচয় দেন। অবাক করা বিষয়, সাঁতার শেখাতে নিয়ে যাওয়া তাঁর দুই ছেলেও মসুলে ছিল।
হুদাইফা দাবি করেন, তাঁর স্বামী কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ করতেন তিনি। এ জন্য বাসায় ফিরে গোসলে ঢুকলে বা ঘুমিয়ে গেলে স্বামীর পোশাক ও পকেট পরীক্ষা করতেন তিনি। এমনকি স্বামীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কি না, সেটাও খুঁজে দেখতেন। কিন্তু কখনোই সন্দেহজনক কিছু পাননি।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে মসুলের আল-নুরি মসজিদ থেকে সেই বক্তব্য দিয়েছিলেন আবু বকর আল-বাগদাদি। এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রথমবার তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যায়। হুদাইফা বলেন, ‘ওই ফুটেজ দেখে আমি ভীষণ চমকে গিয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম, আমার দুই ছেলেকেও মসুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
বাগদাদের কারাগারে থাকা হুদাইফার বিরুদ্ধে আইএসের সম্পৃক্ততা, সংগঠনটির সন্ত্রাসবাদী কাজে জড়িত থাকার তদন্ত করা হচ্ছে। জনাকীর্ণ কারাগারে পাঠাগারের এক নির্জন কোণে বসে তিনি ঘণ্টা দুয়েক বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় আইএসের নির্মম কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। বরং তিনি নিজেকে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। জানান, তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
তবে হুদাইফা আদালতে যেসব জবানবন্দি দিয়েছেন, তার সঙ্গে এমন দাবির কোনো মিল নেই। আইএস সদস্যদের দ্বারা অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার ইয়াজিদিদের করা মামলায় হুদাইফার বিরুদ্ধে অপহৃত মেয়ে ও নারীদের জোরপূর্বক যৌনদাসী বানানোর অভিযোগ রয়েছে।
হুদাইফার জন্ম ১৯৭৬ সালে, একটি রক্ষণশীল ইরাকি পরিবারে। ১৯৯৯ সালে ইব্রাহিম আওয়াদ আল-বাদরির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে আবু বকর আল-বাগদাদি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন ইব্রাহিম। যুক্তরাষ্ট্রের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আল–বাগদাদি ২০১৯ সালে নিহত হন।
আবু বকর আল-বাগদাদি শরিয়াহ আইন নিয়ে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। হুদাইফা বলেন, তখন তাঁর স্বামী ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু উগ্রবাদী ছিলেন না। রক্ষণশীল, তবে খোলামনের একজন মানুষ ছিলেন।
স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছিলেন হুদাইফা। কিন্তু সন্তানদের দিয়ে দিতে বলা হয়েছিল তাঁকে। এ বিষয়ে হুদাইফা বলেন, এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই স্বামীর সঙ্গে রয়ে যান তিনি। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে একের পর এক রক্তাক্ত হামলার ঘটনা ঘটে ইরাকে। হুদাইফা বলেন, তখন বুঝতে বাকি ছিল না যে আমার স্বামী সুন্নি ইসলামি জিহাদি দলের সঙ্গে যুক্ত।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী। পরের বছর মার্কিন বাহিনীর হাতে আটক হন আল-বাগদাদি। বছরখানেক তাঁকে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলের বুকা শিবিরে রাখা হয়। আইএস ও বিভিন্ন জিহাদি সংগঠনের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও সেখানে বন্দী ছিলেন।
হুদাইফা জানান, মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তাঁর স্বামী বদলে যেতে শুরু করেন। তিনি বদমেজাজি হয়ে যান। রেগে গেলে চিৎকার করতে শুরু করেন। এমনকি মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন। এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলে বলতেন, তুমি বুঝবে না। হুদাইফার ধারণা, কারাগারে তাঁর স্বামী যৌন নির্যাতনের (sexual torture) শিকার হয়েছিলেন। তখন ইরাকের আবু গারিব কারাগারে মার্কিন সেনাদের এমন নির্যাতনের ছবি বিশ্বজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল।
বিবিসির পক্ষ থেকে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরকে হুদাইফার এই অভিযোগের বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
হুদাইফা দাবি করেন, তাঁর স্বামী কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ করতেন তিনি। এ জন্য বাসায় ফিরে গোসলে ঢুকলে বা ঘুমিয়ে গেলে স্বামীর পোশাক ও পকেট পরীক্ষা করতেন তিনি। এমনকি স্বামীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কি না, সেটাও খুঁজে দেখতেন। কিন্তু কখনোই সন্দেহজনক কিছু পাননি।
তিনি জানান, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছিলেন হুদাইফা। কিন্তু সন্তানদের দিয়ে দিতে বলা হয়েছিল তাঁকে। এ বিষয়ে হুদাইফা বলেন, এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই স্বামীর সঙ্গে রয়ে যান তিনি। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে একের পর এক রক্তাক্ত হামলার ঘটনা ঘটে ইরাকে। হুদাইফা বলেন, ‘তখন বুঝতে বাকি ছিল না যে আমার স্বামী সুন্নি ইসলামি জিহাদি দলের সঙ্গে যুক্ত।’
ইরাকে সক্রিয় জিহাদি সংগঠনগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে ২০০৬ সালে আইএস প্রতিষ্ঠা পায়। এর বছর চারেক পর ২০১০ সালে সংগঠনের প্রধান হন আবু বকর আল-বাগদাদি।
হুদাইফা বলেন, ‘২০১২ সালে জানুয়ারিতে আমরা সিরিয়ার ইদলিবে চলে যাই। ওই সময় আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আমার স্বামী আইএসের আমির বা প্রধান। তখন তিনি আফগানি পোশাক পরতে শুরু করেন। বড় দাঁড়ি রাখেন। সব সময় সঙ্গে একটি পিস্তল রাখতেন।’
সিরিয়াজুড়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়ে। তখন আবু বকর আল-বাগদাদির পরিবার দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছেড়ে পূর্বে রাকায় চলে যায়। আইএস এই শহরটিকে নিজেদের খেলাফতের রাজধানী বলত। সেখানে থাকা অবস্থায় টেলিভিশনের পর্দায় স্বামীর ফুটেজ দেখে চমকে উঠেছিলেন হুদাইফা।
২০১৪-১৫ সালের দিকে আইএসের কর্মকাণ্ড ও ভয়াবহতা আরও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের তদন্ত দল বলেছে, সংখ্যালঘু ইয়াজিদি গোষ্ঠীর ওপর আইএস গণহত্যা চালিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে আইএস হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ, জোরপূর্বক দাসত্বের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছে।
আইএস প্রধান আল-বাগদাদি কীভাবে নিজের ল্যাপটপ থেকে সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, সে বিষয়েও কথা বলেছেন হুদাইফা। তিনি আরও জানান, আল-বাগদাদি সব সময় কম্পিউটার লকড একটি ব্রিফকেস বহন করতেন। হুদাইফা বলেন, ‘আমি এটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম। কী ঘটছে, তা জানতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার প্রযুক্তিজ্ঞান খুবই কম। আমার কাছে পাসকোড (পাসওয়ার্ড) চাইত।’
পালানোরও চেষ্টা করেছিলেন হুদাইফা। এ সম্পর্কে আইএস প্রধানের স্ত্রী বলেন, ‘একটি তল্লাশিচৌকিতে রক্ষীরা আমাকে আটকে দেন। যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে আমাকে বাসায় ফেরত পাঠান।’
সশস্ত্র গোষ্ঠী আইএসের প্রধান হলেও আল-বাগদাদি কোনো যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেননি বলে মনে করেন তাঁর স্ত্রী হুদাইফা। তিনি জানান, আইএস সদস্যরা যখন মসুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন আল-বাগদাদি রাকায় ছিলেন। পরে তিনি মসুলে যান। আইএস প্রধান হিসেবে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন।
আল-বাগদাদির চারজন স্ত্রী। ২০১৯ সালে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাঁর সঙ্গে দুই সন্তানও নিহত হয়। গুলিতে প্রাণ যায় আল-বাগদাদির দুই স্ত্রীর। তখন হুদাইফা সেখানে ছিলেন না। এর আগে মিথ্যা পরিচয়ে তুরস্কে অবস্থান করছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে সেখানে আটক হন হুদাইফা। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইরাকে ফেরত পাঠানো হয় হুদাইফাকে। এর পর থেকে বাগদাদের কারাগারে বন্দী জীবন কাটছে তাঁর।
আল-বাগদাদি ও হুদাইফার পাঁচ সন্তান। তিন ছেলে, দুই মেয়ে। বড় মেয়ে উমাইমা কারাগারে মায়ের সঙ্গে আছে। আর ১২ বছরের ফাতিমাকে একটি কিশোর বন্দিশালায় রাখা হয়েছে। এক ছেলে সিরিয়ার হোমসে রুশ বিমান হামলায় নিহত হয়েছে। আরেকজন বাবার সঙ্গে একই দিন প্রাণ হারিয়েছে। আর সবচেয়ে ছোট ছেলেটি একটি এতিমখানায় রয়েছে।