ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১০ মাঘ ১৪৩১
শেষ দিনগুলোতে নিভৃতচারী জীবনযাপন, কী অভিমান ছিল রুবেলের?
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Saturday, 10 February, 2024, 2:58 PM
সর্বশেষ আপডেট: Saturday, 10 February, 2024, 3:01 PM

শেষ দিনগুলোতে নিভৃতচারী জীবনযাপন, কী অভিমান ছিল রুবেলের?

শেষ দিনগুলোতে নিভৃতচারী জীবনযাপন, কী অভিমান ছিল রুবেলের?

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে একজন আহমেদ রুবেল। মঞ্চনাটক, সিনেমা বা নাটক—সব মাধ্যমেই তিনি সফল। দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন দুই যুগের বেশি সময়। একের পর এক কাজ করলেও হঠাৎ করেই বেশ কয় বছর ধরে এই অভিনেতা অনেকটাই নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন। সেই খোলস থেকে বেরিয়ে আবার তিনি সরব হচ্ছিলেন অভিনয় অঙ্গনে। এর মধ্যেই বুধবার হঠাৎ করেই মারা যান এই অভিনেতা। এরপরে সহকর্মী ও কাছের মানুষের কথায় উঠে আসছে কেন নিভৃতচারী জীবন যাপন করতেন এই অভিনেতা। কী অভিমান ছিল তাঁর? 

আহমেদ রুবেলের সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল পরিচালক নূরুল আলম আতিকের সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন যেন একটি পরিবারের মতো। নাটক থেকে সিনেমা এই পরিচালকের প্রায় সব কাজেই তাঁকে দেখা গেছে। প্রায়ই তাঁরা আড্ডা দিতেন। গাজীপুর থেকে নূরুল আলম আতিকের বাসায় কিংবা অফিসে ছুটে আসতেন আড্ডা দিতে। তাঁদের আড্ডায় উঠে আসত সমসাময়িক নাটক সিনেমার কথা। সেগুলোকে ছাপিয়ে বিশ্বসাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি, দর্শন, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়। কিন্তু আড্ডায় নিজের প্রসঙ্গে তেমন একটা কথা বলতেন না আহমেদ রুবেল। তবে কখনো যদি প্রশ্ন উঠত তখন শিল্পী হিসেবে নীরব থাকতেন এই অভিনেতা। তাঁর প্রাণচঞ্চলতা হারিয়ে যেত। এই নিয়ে কথা হয় পরিচালক নূরুল আলম আতিকের স্ত্রী মাতিয়া বানু শুকুর সঙ্গে।

মাতিয়া বানু শুকু বলেন, ‘তাঁর (আহমেদ রুবেল) চিন্তাচেতনা–দর্শন আলাদা ছিল। তিনি ভাবনা শেয়ার করার মতো খুব বেশি লোক পেতেন না। যে কারণে বেশির ভাগ নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন। হয়তো নিজের মতো করে পড়াশোনা করতেন, চর্চায় থাকতেন। পরিবারকে সময় দিতেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিজীবনে খুবই মিশুক মানুষ ছিলেন। তাঁর আড্ডাগুলো জীবন্ত থাকত। পরিবারসহ নানা বিষয়ের কথা হতো।’

সত্তর থেকে নব্বই দশকের সিনেমা নিয়ে ব্যাপক জানাশোনা ছিল আহমেদ রুবেলের। কেউ কোনো তথ্য জানতে চাইতে মুহূর্তেই বলে দিতে পারতেন। এসব আগ্রহের কারণে শুধু পরিচালকই নয়, নূরুল আলম আতিকদের টিমের সবার সঙ্গেই এই অভিনেতার আড্ডা জমত।

নুরুল আলম আতিকের সহকারী শ্যামল শিশির বলেন, ‘রুবেল ভাই নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন এটা আমরা জানতাম। তিনি সমসাময়িক যে কাজগুলো নিয়ে কথা বলতেন, তাঁর বেশির ভাগই পছন্দ করতেন না। রুবেল ভাই বলতেন, “কাজগুলোতে শৈল্পিক মান বজায় থাকত না। জীবনকে চিত্রনাট্যে খুঁজে পেতেন না। এ কারণে হয়তো মাসে দু–তিনটি কাজ করতেন।”’


জানা যায়, এই অভিনেতার পরিবারের সঙ্গে সব সময় ভালো সম্পর্ক ছিল। বড় ভাই হৃদ্‌রোগে মারা যাওয়ার পরে পরিবারের একমাত্র ছেলেসন্তান হিসেবে পরিবারকে বেশি সময় দিতেন। এর মধ্যে করোনার শুরুতে মারা যান তাঁর মা। তখন থেকেই বাসায় বেশি সময় থাকতেন। বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা না বললেও পরিবারের কথায় মায়ের মৃত্যুর পরে বিয়ে করেন। সংসার ভালোই চলছিল। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল। এই সময় পরিবারের সঙ্গে কাটাতেন। খুব বেশি পছন্দ না হলে নতুন কাজে নাম লেখাতেন না।

সর্বশেষ আহমেদ রুবেল অভিনয় করেন ‘প্রিয় সত্যজিৎ’ সিনেমায়। সেই সিনেমার পরিচালক ছিলেন প্রসূন রহমান। তাঁদের মধ্যে ছিল দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। রাতবিরাতে তাঁদের দীর্ঘ সময় কথা হতো। গতকাল সময় তখন পৌনে পাঁচটা। এর মধ্যেই হঠাৎ একটি ফোন আসে পরিচালক প্রসূনের কাছে।

ওপাশ থেকে আহমেদ রুবেল বলেন, ‘আজ তাহলে দেখা হচ্ছে।’ ‘ঠিক আছে’ বলে ফোনটি রেখে দেন এই পরিচালক।

প্রসূন রহমান বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। ক্লাস রুমে কখনোই ফোন ধরি না। রুবেল ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো। এর মধ্যে গতকাল রুবেল ভাইয়ের ফোন পেয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সরি বলে ফোনটি রিসিভ করি। ভাই সিনেমার প্রিমিয়ারে যেতে বলেন। তখন তিনি গাড়িতে। আমি আচ্ছা দেখা হচ্ছে বলে রেখে দিই। পরে যখন রাস্তায় বের হই, তখন শুনি তিনি নেই। এটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। কারণ, এমন শিল্পীসত্তার অধিকারী একজন মানুষ কালেভাদ্রে জন্মে না। তাঁর বিকল্প ছিল না। এটাই বারবার মনে হচ্ছে তাঁকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।’

প্রসূন রহমান জানান, তাঁর সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য, সিনেমা দর্শক নিয়ে নিয়মিত কথা হতো। বেশির ভাগ গভীর রাতে কথা হতো। সেই কথা ফুরাত না। কদিন আগেই তাদের দীর্ঘ সময় কথা হয়। ইতালির ও ভারতের একটি উৎসবে ‘প্রিয় সত্যজিৎ’ সিনেমার জন্য পুরস্কার আনতে যাওয়ার ব্যাপারে। সেখানে আহমেদ রুবেল সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন। ইচ্ছা ছিল একটি উৎসবে একসঙ্গে যাবেন। কারণ সর্বশেষ এই সিনেমাটি নিয়ে অনেক আগ্রহী ছিলেন আহমেদ রুবেল। কিন্তু পরবর্তী কিছু ঘটনা এই অভিনেতাকে কষ্টও দিয়েছে।


‘তিনি সব সময় জীবনঘনিষ্ঠ গল্পগুলোতে কাজ করতে চাইতেন। কিন্তু সে ধরনের চিত্রনাট্যের অভাব ছিল। আবার যেগুলো কাজ করতেন, সেগুলো প্রচারেও জটিলতায় পরতে হতো। শৈল্পিক এই কাজগুলো সিনেমা হল বা ওটিটি নীতিনির্ধারকেরা চালাতে চাইতেন না। রুবেল ভাইয়ের কাছে মনে হতো সাহিত্য মানের গ্রহণযোগ্যতা দিনদিন অনেক কমে যাচ্ছে। যেভাবে নাটকের মান দিনদিন কমে যাচ্ছে। এই ভাবনাগুলো তাকে একা করে দিত। যে চর্চার মধ্যে দিয়ে এসেছেন সেটা এখন আর নেই। এগুলো তাকে নীরব করে দিত। যে কারণে তিন–চার বছর ধরে কিছুটা আড়ালেই থাকতেন।’ বলেন প্রসূন রহমান।

মঞ্চপাড়া থেকেই অভিনয় ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। শৈশব থেকেই গুণী অভিনয়শিল্পীদের সান্নিধ্যে নিজেকে তৈরি করেছিলেন আহমেদ রুবেল। সব মাধ্যমে অভিনয় করে পেয়েছিলেন প্রশংসা। সেই চর্চা জীবনব্যাপী চালিয়ে গিয়েছেন। এই সময়ে যেখানে নাট্যাঙ্গন এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে একের পর এক সস্তা কনটেন্টের ভরে গেছে। এগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন এই অভিনেতা।


পরে তাঁকে দেখা যায় ওটিটির কিছু কাজে। সেখানেও থ্রিলারের আধিক্য থাকায় তাঁর একঘেয়েমি মনে হতো। তখন অভিনয়ে সক্রিয় থাকা নিয়ে নিজের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। তাঁকে নিয়ে তরুণ নির্মাতা ও প্রযোজক ফজলে হাসান লিখেছেন, ‘কিন্তু একাকী, বিমর্ষ, নিভৃতচারী জীবনের রূপটা তাঁর ভালো লাগত না মোটেও। এ কারণেই মাঝরাতে প্রিয় মানুষদের কাছে কখনো পৌঁছে যেতেন কখনো ফোনে চলত দীর্ঘ আড্ডা।’ তাঁরা একসঙ্গে ‘মুকুলের যাদুর ঘোড়া’ সিনেমায় কাজ করেছেন। সিনেমাটি দেখে যেতে পারলেন না আহমেদ রুবেল।


সেলিম আল দীনের ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আহমেদ রুবেলের অভিনয়ে হাতেখড়ি। আহমেদ রুবেল অভিনীত প্রথম নাটক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নযাত্রা’। এ ছাড়া ‘বনপাংশুল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘হাতহদাই’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ২০০৫ সাল থেকে টেলিভিশন নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন। আহমেদ রুবেল ১৯৯৩ সালে ‘আখেরী হামলা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে রুপালি পর্দায় (চলচ্চিত্রে) পা রাখেন। পরে তিনি অভিনয় করেছেন ‘চন্দ্রকথা’, ‘ব্যাচেলর’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘গেরিলা’ ইত্যাদি সিনেমায়।

� পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ �







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক : নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: [email protected]
প্রকাশক : প্রবাসী মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন লি.-এর পক্ষে কাজী তোফায়েল আহম্মদ। কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status