জাবি ছাত্রলীগের অপরাধনামা : ক্যাম্পাস যেনো ধর্ষণ থেকে চাঁদাবাজির আস্তানা!
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ছাত্রলীগ নেতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সাভার মডেল থানার পুলিশ ও আশুলিয়া থানার পুলিশ যৌথভাবে এ ঘটনায় অভিযান চালিয়ে তাদের শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার করে। তবে এই শেষ নয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমিদখল, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ এবং নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনায় সারা বছরই বিভিন্ন সংবাদের শিরোনামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি কমিটি ঘোষণার পরে থেকেই আলোচনা-সমালোচনায় ঘুরে ফিরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নামই উঠে আসে। জাবি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য পরিবহনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর, প্রবাসীকে মারধর, বহিরাগতদের মারধর ও ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে মারধর ও সাংবাদিক নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি ৪২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আকতারুজ্জামান সোহেলকে সভাপতি এবং ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান লিটনকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এই ঘোষণার তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নিয়ম থাকলেও ১১ মাস পর ৩৯০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। অথচ শাখা ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদই এক বছর। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নিয়ে জাবি ছাত্রলীগের এমন ঘটনা নতুন নয়। বিগত বছরের কমিটিগুলোতেও মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে দেখা গেছে এমন অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা। বর্তমানে কমিটির সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ৭০ ভাগ নেতাকর্মীর ছাত্রত্ব নেই। এছাড়াও সভাপতি-সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিককে মারধর, চাঁদাবাজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডে বাধা, সাধারণ মানুষকে তুলে এনে মুক্তিপণ আদায় এবং সর্বশেষ ধর্ষণের মতো অভিযোগও উঠেছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে জাবি ছাত্রলীগ সবার আগে। ইতিমধ্যেই অশোভন আচরণ, চাঁদাবাজি, নিজ স্বার্থ কেন্দ্রিক আখের গোছানোসহ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির বিভিন্ন অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন তার অনুসারীরা। সম্প্রতি মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানকে অন্য হলে আশ্রয় ও সংশ্লিষ্ট সিসিটিভি ফুটেজ বিলোপের নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের বিরুদ্ধে। এর আগে মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা ও বহিরাগত এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল সংলগ্ন জঙ্গলে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত যুবক মামুন (৪৫)। তাদের মধ্যে মোস্তাফিজ মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। সে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী। চাঁদাবাজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ধরনের দোকান থেকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ফলে প্রশাসন কোনো ভাসমান দোকান উচ্ছেদ করতে পারছে না। এছাড়াও ২০২৩ সালের ১ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী পানধোয়া এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী মমিনউল্লাহর কাছে দাবি করা পাঁচ লাখ টাকা না পেয়ে লাইনম্যান খায়রুলকে ক্যাম্পাসে এনে মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। গত ২৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা সাভার-আশুলিয়া রুটে চলাচলকারী ২৪টি লেগুনা আটকে রাখেন। তখন লেগুনার চালক ও মালিকপক্ষ অভিযোগ করে বলেন, প্রতিদিন প্রতিটি লেগুনা থেকে ২৫ টাকা করে চাঁদা দেয়া হতো ছাত্রলীগকে। এই রুটে প্রতিদিন ২০০টি লেগুনা চলাচল করে। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন এখন থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা দেয়ার জন্য। চাঁদা আদায়ের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় লেগুনাগুলো আটকে রাখার অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল ফারুক ইমরান, শাহ পরাণ ও হাসান মাহমুদ ফরিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, লেলিন মাহবুব এবং উপছাত্র–বৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আল-রাজি সরকারের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের এক কর্মী গাবতলী থেকে বাসে উঠতে গেলে তাকে বাসে উঠতে না দিয়ে ধাক্কা দেয়ার অভিযোগে সেলফী পরিবহনের ২০টি বাস আটক করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই দিন দুপুরে বাসমালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে লিটনসহ কয়েকজন নেতা। পরে তাদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে বেলা দুইটার দিকে বাসগুলো ছেড়ে দেয়া হয়। গত ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের প্রথম বর্ষের এক ছাত্র এবং তার বান্ধবীর সঙ্গে বাসে হাফ ভাড়া নিয়ে কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ছাত্রী মাথায় আঘাত পান বলে দাবি ওই ছাত্রীর। এ ঘটনার জেরে সাভার পরিবহনের ১৮টি বাস আটক করে ওই হলের এক দল শিক্ষার্থী। পরে হলের ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা ৩০ হাজার টাকা আদায় করে বাসগুলো ছেড়ে দেন। তবে এই আদায়কৃত টাকা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী পাননি। গত ৫ ডিসেম্বর নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সিগারেটের ডিলার কোম্পানির কাছে ছাত্রলীগ নেতাদের দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা ঘটে। কাঙ্খিত পরিমাণ চাঁদা দেয়া না হলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সিগারেট বিক্রির বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা। চাঁদা পরিশোধ না করে ক্যাম্পাসে ঢুকলে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিকে হত্যার হুমকি দেন ছাত্রলীগ নেতারা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে একাধিক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। এ কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকে গ্রন্থাগার নির্মাণ এবং আলবেরুনী হল-সংলগ্ন মাঠের কাজ। গত ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক উবাইদুর রহমান সিদ্দিকীর গাড়িতে একটি অ্যাম্বুলেন্স ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় তিনি তার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কর্মীদের দিয়ে সেটি তিন দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকে রাখেন। পরে নিজের গাড়িটি মেরামত করতে ৭০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি ছেড়ে দেন ওই অধ্যাপক। গত ৬ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতাকে ধাক্কা দেয়ার অভিযোগে ঢাকা থেকে শেরপুরগামী এমডি সুপার নামে একটি বাস ভাঙচুর করে ক্যাম্পাসে ছয় দিন আটকে রাখেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পরে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তারা। তবে সে সময় বাসমালিকের অভিযোগ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মুরশিদ আকন্দ একটি নতুন বাস শেরপুর রুটে রোড পারমিট না পেয়ে বাসটি নামাতে না পেরে ক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দিয়ে এমডি সুপারের বাসটি ভাঙচুর করে আটকে রাখেন। মারধর ও ছিনতাই ২০২২ সালের জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও আরেক নারী শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে হেনস্তার অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দুই ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর পৃথক দুটি লিখিত অভিযোগপত্র দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ক্যাম্পাসে এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও ছিনতাই চেষ্টার অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক শেখ শাহরিয়ার পারভেজ শাওনের বিরুদ্ধে। মীর মশাররফ হোসেন হলের গেস্টরুম চলাকালীন এলোপাতাড়ি চড় মেরে এক শিক্ষার্থীর কান ফাটানোর অভিযোগ উঠে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসান মাহমুদ ফরিদ ও ইতিহাস বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরানের বিরুদ্ধে। তারা উভয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। ২০২৩ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসে ছিনতাইয়ের শিকার হন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) এক সহকারী অধ্যাপক। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাহিদ হাসান ইমনের ওপর এই নির্যাতন চালিয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের আপন ছোট ভাই আরমান খান যুব ও তার সহযোগীরা। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও হলের কক্ষ দখল করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে করেন। একইসঙ্গে চালাচ্ছেন মাদকের কারবার। এরপরে বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে ছাত্রলীগের ৫ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বহিষ্কৃতরা হলেন-জাবি শাখা ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরুল হাসান অমি, সহসম্পাদক বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব ও দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও কার্যকরী সদস্য আরিফুল ইসলাম এবং ছাত্রলীগ কর্মী প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী তানভিরুল ইসলাম। বহিষ্কৃতরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের এবং মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। গত ১০ মার্চ মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠান চলাকালে মঞ্চে উঠতে না দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ এক ব্যান্ড দলের অতিথিকে মারধরের অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কে এম রহমান জাকারিয়া, দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন রনি, উপ-বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক উৎস দত্ত, উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক অরবিন্দ ভৌমিক ও উপ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সবুজ রায়ের বিরুদ্ধে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল পারভেজ এবং শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিনকে লাঞ্ছিত করে তারা। তাদেরকে থামাতে গেলে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিনকেও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। এর আগে ৬ মার্চ মুক্তমঞ্চে কনসার্ট চলাকালে অর্ধশতাধিক বহিরাগতকে মারধর, ছিনতাই এবং বেশ কয়েকজনকে অর্ধনগ্ন করে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের একদল কর্মীর বিরুদ্ধে। রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ এবং সপ্তম ছায়ামঞ্চে অবস্থান করা বহিরাগতদের শনাক্ত করে মারধর ও ছিনতাই করা হয়। গত ৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী পাথালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেনকে তুচ্ছ ঘটনায় মারধরের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দিকে। এছাড়াও সায়েম হাসান নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী কানে অস্ত্রোপচার করায় ১৬ মে ছাত্রলীগের গেস্টরুমে যাননি। এ কারণে শহীদ সালাম-বরকত হলের পলিটিক্যাল ব্লকে ডেকে নিয়ে তাকে হল ছাত্রলীগের নেতারা মারধর করেন। পরদিন রাতে তাকে আবার গেস্টরুমে ডেকে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে মারধর ও মাদক দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মী। পরে ২২ মে এ ঘটনায় প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর ওই হলের ছাত্রলীগের আট নেতার নামে আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। এর আগে ৫ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ইসলামনগর বাজারে এক জুতার দোকানদার ও তার কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি হাসানের বিরুদ্ধে। বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদেরকে রুমে ডেকে মারধর করার অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের নয় কর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে হল প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সাকিবুল ইসলাম ফারাবি। বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলে এক বহিরাগতকে নেশাদ্রব্য খাইয়ে অপহরণ ও নির্যাতন করে ৪৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক অসিত পালের বিরুদ্ধে। অপহরণ ও নির্যাতনে অভিযুক্ত অসিত পালের কক্ষে মদ, গাজা ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম, সিরিঞ্জসহ নানা মাদকদ্রব্য গ্রহণের আলামত পাওয়া যাওয়ায় বহিস্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক রিফাত চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম্বুলেন্স (ঢাকা মেট্রো ছ ৭১-৪৫৪৫) ব্যবহার করে মাদক পরিবহনকালে সাভারের বিপিএটিসি এলাকায় এম্বুলেন্সের সঙ্গে একটি রিকশার সংঘর্ষ ঘটে। এই ঘটনায় রিক্সাচালক ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ চারজন আহত হন। এ ঘটনায় সাভার মডেল থানায় একটি মামলা চলমান রয়েছে। ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলে প্রোগ্রামে আসতে দেরি করায় নিজেদের এক কর্মীকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই সদস্য হলেন নজরুল ইসলাম ও হারুনুর রশীদ। ১২ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা এক প্রবাসীকে মারধরের অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে। মারধরে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মীরা হলেন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী সৈয়দ আফ্রিদি ও রাহাত আলম রিজভী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আরিফ আহমেদ, আইন ও বিচার বিভাগের রাকিব উল ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আজিম সাকিব, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের নাহিদ তমাল রোমান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সৌমিক সরকার ও শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ইতিহাস বিভাগের মো. আদনান। হোটেলে খাবার খাওয়ার পর টাকা চাওয়ায় দোকানিকে মারধর করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ৪৫ তম ব্যাচের আবাসিক ছাত্র এবং শাখা ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আল রাজী সরকার। সাংবাদিক নির্যাতন গত ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট দিবাগত রাত দুইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের অতিথিকক্ষে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক বৈঠক চলাকালে কোনো সাংবাদিক ভিডিও ধারণ করেছেন-এমন সন্দেহে ইউএনবির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আসিফ আল মামুনকে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী। একই বছরের ২২ মার্চ তুচ্ছ ঘটনায় মারামারিকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হল থেকে রড, রামদা, লাঠি, ছুরিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলার উদ্দেশ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে বটতলায় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা তাদের বাধা দেন। একপর্যায়ে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬তম বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে হাবিবুর রহমান লিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের সংবাদ প্রকাশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। ২০২২ সালের ২ আগস্ট মধ্যরাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের গেস্টরুমে এক সাংবাদিককে মারধর করে শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী। এই ঘটনায় জড়িতদের বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে প্রশাসন। তবে ওই ঘটনায় অভিযুক্ত আটজনের মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহকে পরবর্তীতে শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সম্পাদক করা হয়। নিয়োগ বাণিজ্য ও চাঁদা দাবি আনিকা সুবাহ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটনের মেয়ে বন্ধু। তিনি বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইন্সটিটিউটে (বিআইসিএলসি) প্রভাষক পদে চাকরি প্রত্যাশী। ফলে মো. হাবিবুর রহমান লিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইন্সটিটিউটের পরিচালকসহ বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করেন এবং বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেন তার বান্ধবীর চাকরির জন্য। ফলে আপাতত স্থগিত আছে সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া। অপরদিকে ছাত্রলীগের দাবির প্রেক্ষিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পাননি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাদিয়া আফরিন পাপড়ি। যে কারণে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটনের নির্দেশে নেতাকর্মীরা উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং একই সময়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে বাধা দেয়ার পাশাপাশি পরীক্ষার্থীদের উপাচার্যের দপ্তর থেকে বের করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলে তিন কর্মচারী নিয়োগ দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রভোস্টের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয় হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ১৫ নভেম্বর সকাল আটটায় প্রভোস্ট অফিসে তালা দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এরপর চার দফা দাবিতে প্রভোস্টের বাসার সামনে অবস্থান নেয় তারা। হল অফিসে তালা দেয়ার পর নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবছরের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে। আল-বেরুনী হল সংলগ্ন খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দিয়ে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. এনামুল হক এনাম, মাসুফ আহমেদ, আবদুর রহমান ইফতি, মো. আসাদুজ্জামান আসাদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরাফাত ইসলাম বিজয় ও সাংগঠনিক সম্পাদক চিন্ময় সরকার চাঁদা দাবি করে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে। মুক্তিপণ আদায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা রাঙামাটিতে নিজ বাসায় ফরিদ হোসেন ওরফে পাঞ্চু নামের এক ব্যক্তিকে মারধর করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। পরে রাত দেড়টায় ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন তারা। পরবর্তীতে মাদক ব্যবসার অভিযোগ দিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে ভোর ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কাছে পাঞ্চুকে হস্তান্তর করা হয়। ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙামাটি এলাকার বাসিন্দা ফরিদ হোসেনকে বাসা থেকে তুলে এনে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন, সাজ্জাদ শোয়াইব চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান, অর্থ সম্পাদক মো. তৌহিদুল ইসলাম এবং উপ-ছাত্রবৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আলরাজী সরকারের বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গেও বিভিন্ন সময় বেপরোয়া আচরণ করার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে কয়েকজনকে বিভিন্ন সময় বহিস্কার করা হলেও তারা বহাল তবিয়তে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করছে। প্রসঙ্গত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অছাত্রসুলভ আচরণ, ক্যাম্পাসে নৈরাজ্যের অভিযোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত কয়েকমাসে এই বৃহৎ ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কিছু বিপথগামী সদস্যদের দ্বারা সংগঠিত মারধর, ছিনতাই, মাদক সরবরাহ ও চাঁদাবাজির অভিযোগে গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে শাখা ছাত্রলীগ। ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেও কার্যত সে কথার প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা আসকারা পাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অপরাধে নাম জড়াচ্ছে ছাত্রলীগের।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |