ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
সদস্য হোন |  আমাদের জানুন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
শনিবার ২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
চৌগাছায় গাছির অভাবে তোলা হয়নি শত শত খেজুর গাছ!
জুবায়ের হোসেন,যশোর
প্রকাশ: Wednesday, 15 November, 2023, 1:20 AM

চৌগাছায় গাছির অভাবে তোলা হয়নি শত শত খেজুর গাছ!

চৌগাছায় গাছির অভাবে তোলা হয়নি শত শত খেজুর গাছ!

শিশির ভেজা স্নিগ্ধ সকাল, ঘাষের ডগায় শিশির বিন্দু।ঋতু বৈচিত্রে এখন রাতের শেষে কুয়াশা শীতের আগমন বার্তা জানান দিচ্ছে।আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে চৌগাছা উপজেলার মাঠে মাঠে গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত কাজে ব্যস্ত সময় পার করার কথা ছিল কিন্তু সময়ের ব্যবধানে গাছির অভাবে গ্রামীণ এই জনপদে রাস্তার দু’ধারসহ বিভিন্ন পতিত জমিতে পড়ে আছে শত শত খেজুর গাছ। 

অথচ গত এক দশক আগেও পূবালি বাতাসে চির সবুজের বুকচিরা অপরুপ সৌন্দর্যে সকলের মন মাতিয়ে তুলত মিষ্টি খেজুর রস ও গুড়ের ঘ্রাণ। চৌগাছার উপজেলার প্রতিটি বাড়ি থেকে ভেসে আসত মিষ্টি মধুর মৌ মৌ গন্ধ। কাক ডাকা ভোরে থেকে চলত রস সংগ্রহের কাজ। সন্ধ্যায় চলত গাছ পরিচর্যার কাজ। 

খেজুর রস ও গুড়ের জন্য চৌগছিার সুনাম/খ্যাতি রয়েছে দেশ জুড়ে। সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও গাছি। একদশক আগেও বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ পতিত জমিতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ।

ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গাছি সমাবেশ, খেজুরের গুড়ের মেলা ও প্রায় ৫ লাখ খেজুর গাছা রোপণ করা হয়েছে।

গাছিদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য উপজেলা প্রশাসন তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও বর্তমান প্রজন্ম এ পেশা থেকে এক প্রকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। 

বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, গাছিরা গাছ পরিষ্কার বা তোলা-চাঁছার উপকরণ গাছি-দা, দড়ি তৈরিসহ ভাঁড় (মাটির ঠিলে) কিনছেন। এ ছাড়া রস জ্বালানোর জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে তারা ব্যস্ত রয়েছেন।

উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের বাড়ীয়ালী এলাকায় সরেজমিনে গেলে চোখে পড়ে গাছিরা রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুত করছেন। আবার পাশাপাশি অনেক খেজুর গাছ তোলার অভাবে পড়ে আছে। এসব বিষয়ে কথা হয় বাড়ীয়ালী গ্রামের মৃত. সদর আলী’র ছেলে গাছি রমজান আলীর সাথে তিনি জানান, আগে অনেক গাছি ছিল। অনেকে মারা গেছে। বর্তমানে কেউ আর নতুন করে এ কাজ করছে না, যার ফলে গাছির অভাবে শতশত গাছ পড়ে আছে। 

তিনি জানান, আমার নিজের কয়েকটি গাছ আছে এছাড়া ভাগে (অন্যের গাছ বর্গা)নিয়ে আমি রস ও গুড় প্রস্তুত করি। মজুর দিয়ে গাছ তুলতে (প্রস্তুত)গেলে গাছ প্রতি ১০০ টাকা খরচ হয়। নিজে করলে এ খরচটি আমার সাশ্রয় হয়। গত শীত মৌসুমে ২০টি গাছ থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার গুড় ও রস বিক্রি করেছি। প্রতি কেজি গুড় ২শ থেকে ৩শ এবং এক ভাড় রস ২শ থেকে ২শ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ বছর আরও কিছু বেশি গাছ নিয়েছি।  

কথা হয় একই গ্রামের গাছ তোলা (প্রস্তুত) পেশার সাথে জড়িত মৃত. হানেফ আলীর ছেলে আ: হাশিম এবং মৃত. রহমতুল্ল্যার ছেলে শাহাবুদ্দীনের সাথে তারা জানান দু’জন প্রায় দীর্ঘ ৩০ বছর এ পেশার সাথে জড়িত। জীবনের প্রথম দিকে আমরা গাছ তুলতাম মাত্র ৫-১০ টাকা এখন গাছ প্রতি ১শ টাকা মজুরি পায়। তাদের এ সময়টা আসলে মোটামুটি একটি মোটা অংকের টাকা সংগ্রহ করতে পারে। তারা দিনে ১৫-২০টি গাছ তুলতে পারে।

উপজেলার ফুলসারা ইউনিয়নের সলুয়া গ্রামের গাছি জসিম মিয়া বলেন, শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস, গুড়, পিঠা, পুলি ও পায়েস খাওয়ার মহা উৎসবা। শহরে থেকে সকলে গ্রামের বাড়িতে আসে রস-গুড় খেতে। তবে নতুন করে কেউ আর খেজুর গাছ তোলা-কাটার কাজ করতে চাচ্ছে না। তবে খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে। একটি খেজুর গাছ ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। এছাড়া খেজুরর পাতা জ্বালানি কাজেও ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু জয়বায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতনসহ বন বিভাগের নজরদারী না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন উপজেলা জুড়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে।
দূর্গাবরকাঠি গ্রামের কৃষক ওমর আলী জানান, এখন আর তেমন খেজুর গাছ নেই।খেজুর গাছ চলে গেছে ইট ভাটার পেটে। এ অঞ্চলে ১৫ থেকে ২০টি ইট ভাটা রয়েছে। যে যার মতো আইন অমান্য করে গাছ সাবাড় করছে। আবার যে পরিমাণ আছে সেটা তোলার মত পর্যাপ্ত পরিমান গাছি নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইটের মৌসুম শুরুর আগে থেকেই অসাধু কাঠ ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় ভাটার মালিকরা জ্বালানি সংগ্রহ করে। এর মধ্যে খেজুর গাছও রয়েছে।

কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৬৮.১০ বর্গ কিলোমিটার জমিতে খেজুর গাছের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৩১ হাজার। উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর বলছে, উপজেলার ৮০ হেক্টর জমিতে মাত্র ১২৫০০ খেজুর গাছ রয়েছে। 
 
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রইচ উদ্দিন বলেন, গ্রামে গ্রামে কৃষকরা খেজুরগাছের মাথা পরিষ্কারে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতি বছরের মতো এবারও শীতের শুরুতে গাছ চাঁছাছোলাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। পরে হাঁড়ি বসিয়ে রস সংগ্রহ করবেন কৃষক। তিনি আরো বলেন, গত বছর জরিপ করেছিলাম খেজুরগাছ নিয়ে। তখন দেখা গেছে চৌগাছায় প্রায় ৮০-৮৫ হাজার খেজুরগাছ রয়েছে। তবে এসব গাছ ধরে রাখতে হলে ইট ভাটায় খেঁজুরগাছ পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। এদিকে কয়েকজন চাষি জানিয়েছেন, খেজুরগাছ আন্যান্য গাছের মতো বপন করা বা সার মাটি দিতে হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই মাঠে পড়ে থাকা খেজুরের আটি (বিচি) থেকে চারা জন্মায়। বর্তমান খেজুরগাছ ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হওয়ায় বেশ আগের থেকে এ অঞ্চলে গুড়, পাটালির উত্পাদন বহুলাংশে কমে গেছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, যশোরের যশ খেজুরের রস এ আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যরক্ষা করতে উপজেলার বিভিন্ন সড়কের দু ধারে খেজুর গাছের চারা রোপন করেছি। এ পেশার সঙ্গে জড়িত গাছিদের নিয়ে সমাবেশ করে তাদেরকে উৎসহ দিয়ে যাচ্ছি। চলতি বছরের ১৫ ও ১৬ জানুয়ারী দুইদিন ব্যাপী উপজেলা চত্বরে খেজুর গুড়ের মেলাও করা হয়। এ মৌসুমেও মেলা করা হবে। 

সাধারণ মানুষের দাবি নতুন প্রজন্মের মাঝে খেজুর গাছ তোলার বিষয়ে আগ্রহ তৈরি না করলে এক সময় গাছি হারিয়ে যাবে।

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, ১৭/ডি আজাদ সেন্টার, ৫৫ পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status