শেখ হাসিনা : বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক
আব্দুর রহমান
|
আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্মদিন। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। তাঁরই সুদক্ষ নেতৃত্বের কারণে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছি। বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃত। তিনি বলেন, আমার প্রথম পরিচয় আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাই তো পিতার সুমহান হৃদয়বৃত্তিকে ধারণ করে এক মহীয়সী জননী হিসেবে আমরা তাঁকে আবিষ্কার করি এ দেশের সাধারণ মানুষের নানা দুর্যোগ ও সংকটে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে রাজনীতি তাঁর রক্তে প্রবহমান। পারিবারিক আবহের কারণেই পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের নানা কর্মসূচি নিয়ে আলাপচারিতা ও কর্মতৎপরতা প্রত্যক্ষ করে তাঁর মধ্যে একটি রাজনীতিসচেতন মনন তৈরি হয়ে যায়। স্কুলজীবন থেকেই তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং তখন থেকেই সব গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ) শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৬৬ সালের ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে শেখ হাসিনা ওই কলেজের ছাত্রী সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিক সংগ্রামের তিনি একজন নিবিড় ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মুজিবকন্যা হওয়ার কারণেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও সংকটময় পরিস্থিতি তাঁকে পার করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের প্রায় সব সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই ক্ষত বাংলাদেশকে বয়ে যেতে হবে চিরকাল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষতি কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয় এবং সেই শোক আমাদের বহন করে যেতে হবে আজীবন। সৌভাগ্যবশত পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন এবং বেঁচে গিয়েছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ পরিবারের সব সদস্যকে হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে দীর্ঘ ছয় বছর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে প্রবাসে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে। সে সময় মৃত্যু তাদের তাড়া করেছে প্রতি মুহূর্তে। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই সর্বসম্মতভাবে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সে বছর ১৭ মে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সেদিনের এই সিদ্ধান্তই পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের ভাগ্যলিপি বদলে দিয়েছে। একটি অন্ধকার সময় পার করে বস্তুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আবারও সম্ভাবনা ও স্বপ্নের পথে হাঁটতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামরিক সরকারকে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা থেকে সরে এসে সংসদীয় পদ্ধতির মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় তিনি ভূমিকা রাখেন। শেখ হাসিনার ওপর ১৯ বার হত্যাচেষ্টা হয়েছে। ২০০৪ সালে সরাসরি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে যে ন্যক্কারজনক ও ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়, এরকম নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেওয়ার এমন প্রচেষ্টা দেখে সেদিন সমগ্র জাতি স্তম্ভিত হয়ে যায়। বৃষ্টির মতো একের পর এক গ্রেনেড হামলার পরও দলীয় নেতাদের তৈরি মানববর্ম ও আল্লাহর অশেষ রহমতে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। শেখ হাসিনার সঙ্গে বেঁচে যায় বাংলাদেশ ও এ দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। সেই হামলায় শ্রদ্ধেয় আইভী রহমানসহ ২৪ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হন। আহত ও অঙ্গহীন হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন আরও অনেক দলীয় কর্মী। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান লন্ডনে পলাতক আছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দুরন্ত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ অবকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক সাফল্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন, হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু নিয়ন্ত্রণ, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার প্রচলন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, নারী উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সর্বোপরি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তাঁর অতুলনীয় সাফল্য একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্ধারণ করে ইপিজেড স্থাপন করার কাজ চলমান। সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে আইসিটি পার্ক নির্মাণের কাজ চলছে। বেশির ভাগ মহাসড়ককে চার লেন ও ছয় লেনে রূপান্তর করা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এর সফল বাস্তবায়ন শেখ হাসিনা সরকারের একটি বিস্ময়কর সাফল্য। দেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও প্রমাণ করলেন, দেশের অর্থনীতিকে তিনি কতটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং যানজটপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে যানজট কমানোর পাশাপাশি রাজধানীকে একটি দৃষ্টিনন্দন নগরীতে রূপান্তরিত করেছেন। আংশিক চালু হলেও প্রকল্পগুলোর কাজ শিগগিরই সম্পন্ন হবে। এ ছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক মানের ও দৃষ্টিনন্দন তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মাতারবাড়ী বহুমুখী প্রকল্পসহ তাঁর সরকারের গৃহীত দশটি মেগা প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পথে। এসব প্রকল্প সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক বেশি গতি সঞ্চার হবে। করোনার প্রভাবে যখন সারাবিশ্বের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সবাইকে অবাক করে বাংলাদেশ তখনও উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্থাপন করে তিনি বাংলাদেশকে প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপনের গৌরব এনে দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তিচুক্তির ব্যবস্থা নেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো তাঁকে ‘হুপে-বোয়ানি’ শান্তিপদকে ভূষিত করে। ওই সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেন। পরে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছর ধরে বিদ্যমান সীমানা বিরোধ ও ছিটমহল সমস্যার নিষ্পত্তি করে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছে। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর এই মানবিক ভূমিকার জন্য ব্রিটিশ মিডিয়া তাঁকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে আখ্যায়িত করে। পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পুরস্কার দেওয়া হয়। যাদের নেতৃত্ব ও কর্মকাণ্ড একটি টেকসই বিশ্ব এবং সবার জন্য মর্যাদাসম্পন্ন জীবন নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তাদের এই সম্মান দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি তিনি সবসময়ই আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে তিনি শান্তির সপক্ষে যুদ্ধমুক্ত বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। করোনা ভ্যাকসিন সংগ্রহে বিশ্বের সব দেশ যখন মরিয়া হয়ে ওঠে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন সংগ্রহে সবচেয়ে সফল দেশগুলোর মধ্যে সামনের সারিতে ছিল। করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ এর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করেছে। ফলে করোনার প্রভাবে মহামারি ও বিপর্যয় এড়াতে বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়। মুজিববর্ষে তিনি ভূমিহীন ও হতদরিদ্র মানুষদের জন্য গৃহীত আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭টি পরিবারকে ঘর উপহার দিয়ে পুনর্বাসিত করেছেন। সারাবিশ্বে এটি নজিরবিহীন। জয়তু বঙ্গবন্ধুকন্যা। লেখক: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |