ভারত-কানাডা বিরোধের পরিণতি কী?
নতুন সময় ডেস্ক
|
![]() ভারত-কানাডা বিরোধের পরিণতি কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও দেশ থেকে বিদেশি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা অপর দেশটির প্রতি সরকারের অসন্তুষ্টি প্রকাশের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রভাব শেষ পর্যন্ত দুই দেশের জনগণের ওপর পড়তে পারে। ইন্দো-কানাডা সম্পর্কের এই বিরোধ ‘আশ্চর্যজনক’ উল্লেখ করে সাবেক কানাডীয় কূটনীতিক প্যাট্রিসিয়া ফর্টিয়ের বলেছেন, বিদেশি কর্মকর্তাকে কোনও দেশ থেকে বহিষ্কারকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন পদক্ষেপ কেবল তখন নেওয়া হয়, যখন কর্তৃপক্ষ একান্ত আলোচনায় কোনও ইস্যু সমাধানে ব্যর্থ হন। ওয়াশিংটনে কানাডা দূতাবাসে কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফর্টিয়ের বলেছেন, কূটনীতিক বিশ্বে এটি খুব কঠোর পদক্ষেপ। এটি দেশ অপর দেশকে অসন্তুষ্টির তীব্রতা জানান দেয় এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা একটি বড় পদক্ষেপ। কোনও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বড় পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপ শত্রুতাপূর্ণ। কানাডা ও ভারত এমন পদক্ষেপ এখনও নেয়নি। আমি আশা করি এমনটি ঘটবে না। কানাডায় খালিস্তানপন্থি হারদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে সোমবার ভারতকে কাঠগড়ায় তোলেন কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেছিলেন, কানাডার নাগরিক নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের গুপ্তচরদের হাত থাকতে পারে। ট্রুডোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই অভিযোগ অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কানাডার নাগরিক ও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেটিএফ প্রধান নিজ্জারকে গত ১৮ জুন গুলি করে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের পাঞ্জাবি অধ্যুষিত শিখদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের পার্কিংয়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। দীর্ঘদিন ধরে তাকে খুঁজছিল ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। তার মাথার দাম ১০ লাখ রুপি ঘোষণা করেছিল নয়াদিল্লি। বলিভিয়া, ডোমিনিকান রিপাবলিক ও পেরুতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক এই কূটনীতিক বলেছেন, যদি নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার জড়িত থাকে তাহলে তা ‘বড় ঘটনা’। তবে সতর্কতার সঙ্গে তিনি বলছেন, গোয়েন্দা তথ্য-প্রমাণ নয়। প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ করা দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। তার মতে, কম গুরুত্বপূর্ণ বিরোধ ও ইস্যুতে কূটনৈতিক পদক্ষেপের ক্রমানুসারে সরকারগুলো প্রথমে একে অপরকে নোট পাঠায়। আরেকটি বড় পদক্ষেপ হলো রাষ্ট্রদূতকে তলব করে অসন্তুষ্টির জানান দেওয়া। এরপর কূটনীতিক প্রত্যাহার করা হয়। ফর্টিয়ের বলছেন, ভ্রমণ সতর্কতা জারি রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার আরেকটি কূটনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে। এটি খুব অস্বাভাবিক নয়। কানাডিয়ান গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স ইনস্টিটিউটের কনস্যুলার সেবা বিশেষজ্ঞ ফর্টিয়ের বলেন, এই ধরনের বার্তা হলো ইঙ্গিত দেওয়া। চীন ও ভারতের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কানাডায় অধ্যয়ন করে। ফলে এই সতর্কতার ইঙ্গিত হলো হয়তো ভারত শিক্ষার্থী পাঠানো বন্ধ করতে পারে এবং এসব শিক্ষার্থীকে অন্য কোনও দেশে পাঠানোরে উদ্যোগ নিতে পারে। এই বিরোধের জেরে ইতোমধ্যে দুই দেশের বাণিজ্য আলোচনা ও অক্টোবরের জন্য পরিকল্পিত একটি বাণিজ্য মিশন স্থগিত করা হয়েছে। ফর্টিয়ের বলছেন, তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো কানাডীয়রা বাণিজ্য আলোচনা স্থগিতের প্রভাব টের পাবেন না। কারণ, এগুলো হলো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য। কিন্তু এই বিরোধের না অবসান হলে অনেক কিছু সামনে আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র খুব সতর্কতার সঙ্গে একটি বিবৃতি দিয়েছে। অন্য দেশগুলো বলেছে তারা উদ্বিগ্ন। যুক্তরাজ্য জানিয়েছে তারা ভারতের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যাবে। ভূরাজনীতি, রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা চালিত হচ্ছে অপর দেশগুলো। কানাডার একটি ইন্দো-প্রশান্ত কৌশল রয়েছে। কিন্তু ভারত সঙ্গে না থাকলে ইন্দো-প্রশান্ত কৌশলের কোনও অর্থ নেই। ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের প্রধান রোনাল্ড প্যারিস বলছেন, এটি হয়তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতার শুরু মাত্র, এই উত্তেজনার অবসান নাকি আরও খারাপ হবে তা অস্পষ্ট। কারণ, এখনও নিজ্জার হত্যার তদন্ত চলমান। রোনাল্ড প্যারিস বলেন, দুই দেশের কূটনৈতিক উত্তেজনার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি আমরা। বিরোধের অবসান কঠিন হবে। কারণ, ভারত সরকার প্রকাশ্যে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ট্রুডোর সাবেক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্যারিস বলছেন, কানাডার বিরুদ্ধে আরও পাল্টা পদক্ষেপ ভারত নেবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। সম্ভাব্য এসব পদক্ষেপের মধ্যে থাকতে পারে বাণিজ্য স্থগিত করা। কানাডাও ভারতের বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। প্যারিস আরও বলেন, মনে হচ্ছে কানাডার পক্ষ থেকে ব্যাক চ্যানেল ও পর্দার আড়ালে কূটনীতির মাধ্যমে এবং মিত্রদের সহযোগিতায় ভারতীয়দের সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তা হয়তো কাজে আসেনি। তিনি উল্লেখ করেছেন, কানাডা ও ভারত সাধারণত নিজেদের বন্ধু দেশ হিসেবে মনে করে। যদিও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা রয়েছে। আরও তথ্য সামনে আসার আগ পর্যন্ত আমি খুব বেশি পদক্ষেপের প্রত্যাশা করছি না। এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন অব কানাডার প্রেসিডেন্ট ও সিইও জেফ নাঙ্কিভেল বলেছেন, কানাডার দশম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে রয়েছে কয়লা, সার ও মসুর ডাল। নয়াদিল্লি যদি শাস্তিমূলক কোনও পদক্ষেপ নেয় তাহলে প্রথম আঘাত আসবে কানাডা থেকে কৃষিপণ্য আমদানিতে। ২০২২ সালে ৩ লাখ ২০ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী কানাডায় অধ্যয়নে এসেছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এটি হয়তো প্রভাবিত হবে না। ভারতে কানাডায় উচ্চশিক্ষার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। হংকং ও ম্যাকাউয়ে কানাডার কনসাল জেনারেল হিসেবে কাজ করা নাঙ্কিভেল বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘ বা জি-২০-তে কোনও পদক্ষেপের পক্ষে সমর্থন বা দরকষাকষির ক্ষেত্রে কানাডা হয়ত ব্যর্থ হবে, ভারত তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তবে এখনও আশাবাদী জানিয়ে তিনি বলেন, এটি খুব গুরুতর ফৌজদারি মামলা। এটি ন্যায়বিচারের বিষয়। আবার এটি একটি গুরুতর কূটনৈতিক ইস্যু। কিন্তু কানাডা ও ভারতের জনগণের সম্পর্ক খুব সমৃদ্ধ ও জটিল। নাঙ্কিভেল বলেন, কানাডা ও চীনের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা আমরা দেখেছি। কিন্তু বাণিজ্য বেড়ে চলেছে। চীনে কানাডার রফতানি বাড়ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বলিষ্ঠ। আমি মনে করি ভারতের সঙ্গেও এমন সম্পর্ক বজায় রাখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |