জাল্লিকাট্টু: নিষ্ঠুর বাস্তবতার সুচারু চলচ্চিত্রায়ন
নতুন সময় ডেস্ক
|
কতটা সত্য জীবজগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব? আদৌ কি মানবজাতির আমরা সবাই 'মানুষ' হয়ে উঠতে পেরেছি? নাকি নৃশংসতায়, হিংস্রতায় আর নিষ্ঠুরতায় মানবজাতি পেছনে ফেলে দিতে পারে সবাইকে? এমন সব প্রশ্ন যদি আপনার মনে না জেগে থাকে, তবে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য করবে লিজো জস পেল্লিসেরি পরিচালিত মালায়লাম ভাষার সিনেমা 'জালিকাট্টু'। দৌড়! দৌড়! দৌড়! সমস্ত দোকানপাট, বাগান, বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে মোষ ছুটে চলেছে নিজের গতিতে। ধরতে পারছে না কেউ! কিন্তু সময় যত পেরোচ্ছে, মাইলের পর মাইল অতিক্রম করছে মোষ। একইসাথে বাড়ছে মোষের পেছনে ধাওয়া করা মানুষের সংখ্যা। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ছুটন্ত মোষের অস্তিত্বই ক্রমশ উদঘাটিত করে চলেছে কতগুলো আপাতসাধারণ জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সময় যত পেরোচ্ছে, রাত যত দীর্ঘ হচ্ছে, ততই রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে, যুক্ত হচ্ছে অপ্রত্যাশিত ঘটনাক্রম। তাই এ গল্পের 'প্রোটাগনিস্ট' বলুন বা 'সূত্রধর', সবটাই কিন্তু এই মেটাফরিক্যাল মোষ, যার 'রূপকধর্মী অস্তিত্ব' ঘিরে আবর্তিত হয়েছে মূল কাহিনি। তবে ব্যতিক্রমী এ চিত্রনাট্যের শক্তিশালী দিক মূল প্লটের সাথে টানটান করে বেধে রাখা একাধিক সাবপ্লট, যেগুলো গল্পের কাহিনীকে কখনও একমুখী হতে দেয় না। কোনো গল্পেই দর্শককে থিতু হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি, কেননা সম্ভবত তাদের প্রত্যেকটিই অসম্পূর্ণ। মনে একের পর এক প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাবে এ সিনেমা, কিন্তু উত্তর মিলবে কি না, সেই নিশ্চয়তা নেই। সাবপ্লটগুলো সম্বন্ধে কোনো বিস্তারিত তথ্যে যাব না, তবে যে সাবপ্লট হয়তো সবচাইতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, তা হলো ভার্কির দুই কর্মচারী অ্যান্থনি আর কুট্টাচানের মধ্যে ব্যক্তিগত সংঘাত, প্রতিহিংসাপরায়ণতা আর তীব্র বিদ্বেষ। এতসব ঘটনাক্রম দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে ৯০ মিনিট কেটে যাবে, বুঝতেই পারবেন না আপনি। সিনেমার শুরু যেখানে হয় ভোররাতে বহু মানুষের চক্ষুরুন্মীলনের মাধ্যমে, ৯০ মিনিট শেষে এসে আপনি বুঝতে পারেন, আদতে চোখ খোলেনি কারুর। রাতের ঘনীভূত হওয়া অন্ধকার যে সেখানে উপস্থিত শত শত মানুষরূপী শূকরের মনের তাল তাল অন্ধকার, সেটাও বোঝা যায় একসময়। বৃদ্ধ এক কৃষক তার স্বল্প উপস্থিতিতে সিনেমার মর্মার্থ অনেকাংশে ব্যক্ত করতে চান। তার বলা কথায় ইংরেজি সাবটাইটেলে যখন উঠে আসে, They may move around on two legs, but they are beasts. অর্থাৎ, তারা হয়তো দু'পায়ে হাঁটে, কিন্তু আসলে তারা জানোয়ার। এর থেকে সার্থক কোনো সংলাপ হতে পারতো না। সিনেমার শেষে এসে ছোট্ট দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয় প্রাগৈতিহাসিক কালে, যেখানে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, আমরা এখনও সেই 'Hunter-Gatherer'-ই আছি, বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। এবারে আসা যাক নির্মাণশৈলীর বিষয়ে। পেল্লিসেরির পরিচালনায় বাকি সবার কাজের সাথে একটা স্বাতন্ত্র্য তো আছেই, এমনকি তার নিজের কাজগুলোর মধ্যেও খুব একটা সাদৃশ্য নেই, আর এখানেই তিনি সার্থক। তবে এ সিনেমায় সবচেয়ে বড় বাজি মেরেছেন সিনেমাটোগ্রাফার গিরিশ গঙ্গাধরণ। বিশেষ করে এই সিনেমায় তিনি যেভাবে একের পর এক লং শট ব্যবহার করেছেন, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। পুরো শটে কোনোরকম কাট না করে, টানা পাঁচ বা ছয় মিনিটেরও বেশি সময় ধরে কোনো কোনো শট– সাথে চলছে সাবজেক্টের অনবরত স্থান পরিবর্তন। এমনটা শুধু একবার নয়, বারবার দেখা গিয়েছে, বিশেষ করে দিনের দৃশ্যগুলোতে ক্যামেরা মুভমেন্টে যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এত বৈচিত্র্যময় ক্যামেরা মুভমেন্টের মধ্যেও ছোট ছোট গ্লিম্পস শট বা কুইক কাট শটের অভাব নেই এতে। বৈচিত্র্যও যেন এ সিনেমার অন্যতম সম্পদ। দিনের দৃশ্য শুরুর দিকে বেশি থাকলেও এই মুভির ব্রহ্মাস্ত্র কিন্তু এর রাতের দৃশ্যগুলো। পরিচালক আর সিনেমাটোগ্রাফার দুজনেই তাই চিত্রনাট্যের সাথে তাল মিলিয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে এর ফায়দা লুটেছেন। বিশেষত ৫০ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই রূদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি তৈরির এক আপ্রাণ প্রচেষ্টা দেখা গেছে। আর বলতে দ্বিধা নেই, সেই প্রচেষ্টায় তারা সার্থক। তবে কৃতিত্ব অনেকটা প্রাপ্য মিউজিক ডিরেক্টর প্রশান্ত পিল্লাই আর সাউন্ড ডিজাইনার রেঙ্গানাথ রবির। এমনভাবে করা হয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং যে অন্ধকারে দেখতে বসে হোম থিয়েটারের আওয়াজে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সাসপেন্স বজায় রাখতে সাউন্ড ডিজাইনার ঘড়ির আওয়াজকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা প্রশংসার দাবিদার। ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজটাও যথেষ্ট সুস্পষ্ট শোনায়। অভিনেতা ও অন্যান্য কলাকুশলীর প্রসঙ্গে বলতে গেলে, এখানে তথাকথিত কোনো তারকা নেই। সবাই চরিত্রাভিনেতা আর নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাযথভাবে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় অ্যান্থনির চরিত্রে অভিনয়কারী অ্যান্থনি ভার্গিজের নাম। আঙ্গামাল্লি ডায়েরিজের মতো এখানেও তিনি একপ্রকার 'opus of violence' সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। এটা আর পাঁচটা মালায়ালাম সিনেমার মতো 'ফিল গুড' নয়, যা দেখে আপনি অনুপ্রাণিত বোধ করবেন। শেষপর্যন্ত দেখে মানবজাতির ব্যবহারের প্রতি ঘৃণাবোধও জাগতে পারে। বিশেষ করে যারা ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ হতাশার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছেন, তাদের জন্য তো না দেখার পরামর্শই থাকবে। তবে সিনেমার জন্য সিনেমাকে যারা ভালোবাসেন, যারা সমাজব্যবস্থায় মানুষের বর্তমান অবস্থান নিয়ে ভাবেন, যারা বাস্তবের মাটিতে বসে বাস্তবতাকেই পর্দায় আলোকিত করে দেখতে চান, তাদের জন্য 'জাল্লিকাট্টু' শুধু একবার নয়, বারবার দেখার মতো সিনেমা। অবশেষে, ৯৩ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে (অস্কার) ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে ‘জাল্লিকাট্টু’। ২৭টি সিনেমার মধ্যে এই চলচ্চিত্র নির্বাচিত হওয়ার অনেক কারণ ছিল। সবচেয়ে উপযুক্ত কারণ বোধ হয় এটাই যে, ছোট্ট অঞ্চল, ছোট একটা জাতি থেকে গল্পটা শুরু হলেও এর অন্তর্নিহিত বার্তাটা কিন্তু সার্বজনীন, সমগ্র মানবসমাজের জন্য সত্য। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই চলচ্চিত্র। কেননা মোষ ব্যতীত এখানে অ্যান্টাগনিস্ট সবাই, এমনকি আপনার বিবেকের কাছে আপনিও তা-ই। শুত্র: রোর বাংলা |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |